রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে গতিপথ হারাচ্ছে পদ্মা, বাড়ছে ভাঙন

  • কুষ্টিয়া প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ০৫:১৪ পিএম
রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে গতিপথ হারাচ্ছে পদ্মা, বাড়ছে ভাঙন

ঢাকা: রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রোয়েনে বাধা পেয়ে নদী স্বাভাবিক গতিপথ হারাতে বসেছে প্রমত্ত পদ্মা। এতে আগ্রাসী হয়ে উঠছে বৃহৎ এই নদীটি। যার প্রভাব পড়ছে নদীপাড়ের মানুষদের উপর। ইতোমধ্যে সরকারী-বেসরকারী জনগুরুত্বপূর্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো বিলীন হয়েছে পদ্মার গর্ভে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পদ্মার ডানপাশের কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বহলবাড়িয়া ও তালবাড়িয়া এ দুই ইউনিয়নের সাত কিলোমিটার এলাকায় প্রবল ভাঙনে কৃষিজমি, বাড়িঘর, স্কুল মাদ্রাসা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি টাওয়ার ভেঙ্গে পড়েছে। এছাড়া উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলার সঙ্গে সংযুক্ত একমাত্র মহাসড়কটিও চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এবছর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষ ও ভেড়ামারা ৪১০ মেগা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ নানা অবকাঠামো।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর দাবি, অবিলম্বে এই ভাঙ্গন ঠেকাতে স্থায়ী তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কথিত বিশেষজ্ঞদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে পুনর্বাসন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছেন, এ মুহুর্তে জরুরী কাজ হিসেবে বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানো হচ্ছে। তবে নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করবেন।

এদিকে আক্রান্ত এলাকার সর্বস্ব খুইয়ে ক্ষুব্ধ আশ্রয়হীনরা কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক অবরোধ করেন। এসময় স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক আব্দুল মোনিন বলেন, ‘পদ্মার বাম তীরে মূল কইজের মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পোর্ট নির্মানে প্রায় এক কিলোমিটার গ্রোয়েন নির্মান করা হয়েছে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটালো প্রকল্প কর্তৃপক্ষ অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা মন্ত্রনালয় থেকে কোন অনাপত্তিটাও নেয়নি তারা। আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডও এর বিরূপ ভয়াবহতা সম্পর্কে আগে থেকে আমাদের কিছুই জানায়নি। যাদের অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতায় শান্ত পদ্মা অশান্ত হয়েছে তাদের বিচার চাই আমরা।’

স্থানীয় সাহেবনগর গ্রামের মোহাম্মদ নূর সালাম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, পারমাণবিক (ঈশ্বরদীর রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) দেয়ার কারণে তিন কিলোমিটার নদী এখানে ভেঙে আসছে। আমাদের বাড়িঘর হুমকির মুখে। জমিতো গেছেই, এখন শুধু বাড়িঘর টুকু আছে। তাও ভাঙার মুখে আছে। এই নদী ভাঙন কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিশেষ আবেদন। এটা যেন দ্রুত সংস্কার করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, এই ভাঙার পরেও যদি আমার বাড়িঘর টুকু থাকে, সারাদিন কাজ করি। কাজ করে যে মাথার নিচে যদি ছাদ না থাকে আমরা থাকবো কোথায়? তিনি বলেন, আমাদের বিশাল সমস্যা। সরকারের কাছে ব্যাকুল আবেদন যত দ্রুত এই কাজটা সরকার যেন করে দেয়। নদী তীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন একই এলাকার রুহুল কুদ্দুস নামে একজন বৃদ্ধ কৃষক। নদী ভাঙ্গন নিয়ে এই প্রতিবেদক কথা বলতে চাইলেই তিনি কেঁদে ফেলেন। রুহুল কুদ্দুস কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এখন এখানে নদীর কিনারে যার যা জায়গা জমি ছিল সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের ঘরবাড়ি সবই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই দেশের (এলাকা) মানুষ যাবে কোথায়? কারো সাথে আর কারো দেখা হবে না। আজ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ৩/৪ কিলোমিটার নদী ভেঙে চলে আসছে। এখানে এখন বিদ্যুৎ লাইন, সামনে উত্তরবঙ্গের সড়ক, এটাও থাকবে না। এ সরকারের কাছে আমার আকুল আবেদন আমাদের এইটার যেন ব্যবস্থা করেন।

একই এলাকার মেহেদী হাসান নামের যুবক বলেন, এর আগেও বাঁধ দেয়া হয়েছে কিন্তু বাঁধের কাজটা সেই ভাবে মানসম্মত না হওয়ায় কারণে আবার নদীর গর্ভে চলে গেছে। এখান থেকে নদীর দূরত্ব ছিল তিন কিলোমিটার। সেই নদী ভাঙতে ভাঙতে ৩০ মিটারও আর নেই। এলাকার বাড়িঘরে যা জিনিসপত্র ছিল সব নিয়ে চলে গেছে। স্থানীয় সাহেবনগর জামে উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক আবু আনসারী বলেন, বর্তমানে মাদ্রাসা থেকে যতটুকু নদী দেখা যাচ্ছে এটা যদি কিলোমিটার হিসাব করা যায় ১০০ মিটার হতে পারে। এই ১০০ মিটার ভাঙলেই আমরা দেখতে পাবো আমাদের মাদ্রাসা পদ্মা নদীতে চলে গেছে। এখন আমাদের মাদ্রাসায় প্রায় সাড়ে ৬০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়াও প্রায় ৩২ জন শিক্ষক রয়েছে। আমরা এখানে দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানাই।

মিরপুর উপজেলার সাহেব নগর গ্রামের বৃদ্ধা সোমেলা খাতুন বলেন, ‘আহ হা হা, সুনার সার ভুঁই, এক দাগে ১০ বিঘি ভুঁই আমার। উর বাপ দুনিয়াই তিন বিদায় হয়ে গেছে, তিনডি ছাওয়াল এই ভুই আমাক দিয়ে গিছিলি। একন সব শ্যাস কইরি দেচে গাংয়ে। একটু মাতা গুইজি দাড়ানির জাগাও নি, কোন যায়ে দাঁড়াবো আর খাবো কি? ঘরে কিচ্চু বুলতি কিচ্চু নি, এক যা আচে তুমরা এইডাই ঠেকা দেও, বুলাক দিয়ে গাং বাদি দেও’।

ঘরহারা গৃহবধু রেখা খাতুন বলেন, ‘জমি জায়গা যা ছিলো সবই গেছে। এখন মাথা গোঁজার জাগাডাও নি। সর্বশান্ত হয়ে আমার অবস্থাও এখন আশ্রয়হীণ ভাসমানদের দলে। পাকা বাঁধ না হলি এই ভাঙ্গন কোন ভাবেই ঠেকানি যাবি না’ এখন যে বালুর বস্তা দিয়ে ঠেকাতি চাচ্ছে, ইতে কোন কাজই হচ্ছেনা, সবই  গভীর পানিত তলা যাচ্ছে’।

একেবারে পাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মীর আব্দুল করীম ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আহসানুল হক খান চৌধুরী বলেন, ‘ভাঙ্গনটি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, যে কোন মুহুর্তে আমার কলেজটি জাস্ট পাড়ের উপর থেকে কাত হয়ে গভীর পানিতে তলিয়ে যাবে। চোখের সামনে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। কলেজটি নদী গর্ভে যাওয়া মাত্রই কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী মহাসড়ক যেটি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর বঙ্গের ২১টি জেলার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সড়ক সেটিও চলে যাবে। ইতোমধ্যে জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি টাওয়ার ধ্বসে গেছে নদীতে, এখন হয়ত অপেক্ষায় আছে মহাসড়কটিও’।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী  প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, ‘এখন পানি কমার সময় পদ্মার তীব্র ভাঙ্গন রোধে তাৎক্ষনিক জরুরী আপতকালীন কাজ হিসেবে বালিভর্তি জিওব্যাগ ফেলানো হচ্ছে। যাতে করে জানমালের ক্ষতির পরিমান যতটা সম্ভব কমানো যায়। তবে এর স্থায়ী সমাধান হবে আমাদের অনুমোদিত প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে।’

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হামিদ জানান, ‘পদ্মার ডান তীরে ভাঙ্গন কবলিত ৯ কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মানে এক হাজার ৪শ ৭২ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে অনুমোদন প্রাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ এই অর্থ বছরেই শুরু হবে।

এসএস

Link copied!