কুমিল্লা: গ্রাম থেকে শহরে এসে নতুন জীবনের আশায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন সবুজ (ছদ্মনাম)। মাত্র ৭০০০ টাকায় কেনা একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকায় ফুটপাতে কাপড় বিক্রি শুরু করছিলেন তিনি। দোকান দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় রাস্তার এক কোনে গাড়ি রেখে তার ছোট্ট ব্যবসা মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু প্রতিদিনই তার আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজদের হাতে।
সবুজ জানান, হঠাৎ করেই পুলিশের অভিযানে তার ভ্যানগাড়ি আটক হয়। পরে, গাড়ি ছাড়াতে গুনতে হয় ১৫’শ টাকা। শুধু পুলিশের হাতে চাঁদা নয়, এলাকার চাঁদাবাজরাও নানাভাবে টাকা দাবি করে। এই চাঁদার বোঝা এতটাই বেশি যে, ব্যবসায় কোনো লাভ থাকছে না।
তার মতোই আরও অনেক হকারের একই অবস্থা। ফুটপাত কিংবা রাস্তার পাশে ব্যবসা করতে গেলে পুলিশের কাছে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে কখনো গাড়ি জব্দ হয়, কখনো ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
কুমিল্লার ফুটপাতে চাঁদাবাজি নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে আলোচনা হলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। কান্দিরপাড়সহ শহরের বিভিন্ন সড়কে ফুটপাত এবং সড়কের বড় অংশ দখল করে বসানো হয়েছে ছোট দোকান। ফুটপাতের দখলদারিত্ব এবং চাঁদাবাজির কারণে শহরের পথচারীদেরও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এই চাঁদাবাজি থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আদায় করা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতারা এবং পুলিশের একটি অসাধু অংশ এই টাকার ভাগ পায়। কান্দিরপাড় এলাকায় প্রায় দেড়-দুই হাজার ছোট দোকান রয়েছে, যেখানে দিন-রাত শিফট ভাগ করে ব্যবসা চলে। এসব দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়, আর পুলিশের অভিযানের নাম করে গাড়ি ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ি ছাড়াতে বাধ্য হয়ে হকারদের টাকা দিতে হয়।
এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কান্দিরপাড় এলাকায় কয়েকজনকে চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। পুলিশ এবং এলাকার কিছু নেতা মিলে এই চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কথা বললে ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।’
চাঁদাবাজি নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। অভিযোগ রয়েছে, অনেকেই এই চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। এদিকে ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে বসানো দোকানপাটের কারণে পথচারীরা মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। চলাচলের জায়গা সংকুচিত হওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা যেমন বাড়ছে, তেমনি জনজীবন প্রতিদিনই বিপর্যস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে দ্রুত প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা দাবি করেছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ এবং ফুটপাত দখলমুক্ত করতে সুষ্ঠু তদন্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। অন্যথায়, এই দুর্নীতি ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, কুমিল্লায় ফুটপাতে চাঁদাবাজি ও পুলিশের মাধ্যমে অর্থ আদায় অত্যন্ত নিন্দনীয়। এটি খুচরা ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে ফেলছে এবং আইনের শাসনের প্রতি জনআস্থা নষ্ট করছে। আমরা সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে দোষীদের দ্রুত শাস্তি ও চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানাই। প্রশাসনকে স্বচ্ছ তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ নিরাপদে ব্যবসা ও চলাচল করতে পারে।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লার আহ্বায়ক মো: সাকিব হোসাইন বলেন, এ সকল সংবাদ অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা এখনো এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত তারা হয়তো এখনও জুলাইয়ের স্পিরিটকে ধারণ করতে পারেননি। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সকল নাগরিককে সমান প্ল্যাটফর্মে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ সকল চাঁদাবাজ এবং অসাধু পুলিশকে আইনের আওতায় আনা হোক। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই।
চাঁদাবাজীর বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরাফাতুল ইসলাম বলেন, আমরা এরকম কোন অভিযোগ পাই নাই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এসএস
আপনার মতামত লিখুন :