মুন্সিগঞ্জ : ‘আমার বোনের অস্তিত্ব শেষ হইয়া গেল। আমার বোনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পোলাপানগুলাও মারা গেল। আমরা কেমনে ঠিক থাকমু। মানুষ একটা শোক ভুলতে পারে না, আমরা কেমনে চারটা শোক ভুলমু!’ বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা–মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় বাসচাপায় নিহত আমেনা আক্তারের ছোট বোন জোছনা আক্তার।
আমেনা ও জোছনা মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নন্দনকোনা গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত সুমন খানের মেয়ে। টোল প্লাজার দুর্ঘটনায় নিহত জোছনার স্বজনেরা হলেন তাঁর বড় বোন আমেনা আক্তার (৪০), আমেনার বড় মেয়ে ইসরাত জাহান (২৪), ছোট মেয়ে রিহা মণি (১১), আমেনার নাতি আইয়াজ হোসেন (২)।
স্বজনেরা বলেন, আমেনা বেগম শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর জুরাইনের কমিশনার রোডের বাড়ি থেকে বড় মেয়ে ইসরাত জাহান, মেজ মেয়ে অনামিকা (২০), ছোট মেয়ে রিহা মণি, অনামিকার ছেলে আইয়াজ হোসেন, অনামিকার স্বামী সোহান (২৮) এবং অনামিকার ননদ নাদিয়া আক্তারকে (১৭) নিয়ে প্রাইভেট কারে গোপালগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেন।
তাঁদের প্রাইভেট কারটি কেরানীগঞ্জের ধলেশ্বরী সেতুর টোল পরিশোধ করার সময় বাসচাপার শিকার হয়। এ ঘটনায় আমেনাসহ প্রাইভেট কারে থাকা চারজন হাসপাতালে মারা যান।
একই ঘটনায় এই চারজন ছাড়াও মারা যান টোল প্লাজায় থাকা মোটরসাইকেল আরোহী রেশমা আক্তার (২৬) ও তাঁর ছেলে মো. আবদুল্লাহ (৭)। গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন আমেনার মেয়ে অনামিকা, অনামিকার স্বামী মো. সোহান, সোহানের বোন নাদিয়া আক্তার (১৭) ও মোটরসাইকেলের চালক সুমন মিয়া (৪২)।
জোছনা আক্তার বলেন, ‘আমেনা বলেছিল গোপালগঞ্জ থেকে শুক্রবার সন্ধ্যার আগে ফিরবে। সে সিরাজদিখানে আমাদের বাড়িতে রাতে সবাইকে নিয়ে থাকবে। অনেক দিন পর বোন, ভাগনিদের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে খুশি ছিলাম। কে জানত আমাদের খুশি এমনে শেষ হইয়া যাইব! আমার বোন, বোনের সন্তানদের আল্লাহ এভাবে নিয়া যাইব।’
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিহত আমেনা আক্তারের বাবার বাড়ি সিরাদিখানের নন্দনকোনা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ভেতর আমেনা আক্তারের মা-বোনেরা সবাই বিলাপ করছেন। অন্য স্বজনেরা তাঁদের বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
মেয়ে, নাতি ও পুতিদের হারিয়ে বাক্রুদ্ধ আমেনার মা জোবেদা খাতুন। নিস্তেজ হয়ে আসা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার মরার বয়স হয়েছে। আল্লাহ আমাকে নিল না। ওগো সবাইরে নিয়া গেল। আমরা কেমনে সইমু?’
টোল প্লাজার সিসিটিভিতে দুর্ঘটনার ভিডিওটি ধরা পড়েছে। এতে দেখা গেছে, ধলেশ্বরী টোল প্লাজার মাওয়ামুখী লেনে একটি মোটরসাইকেল টোল পরিশোধের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। এর পেছনে একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয় আরও একটি প্রাইভেট কার।
অল্প কিছুক্ষণ পরেই বেপরোয়া গতিতে ব্যাপারী পরিবহনের একটি বাস দ্রুত টোল প্লাজার দিকে আসতে থাকে। টোল প্লাজার সামনে এলে বাসের গতি আরও বেড়ে যায়। এ সময় বাসটি প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলকে দুমড়েমুচড়ে টোল প্লাজার বাইরে নিয়ে যায়।
গতকাল দুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয় আহত ব্যক্তিদের। কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জনকে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচজন হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান। আহত পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। দুজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনজনের মধ্যে গুরুতর আহত রেশমাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) পাঠানো হয়েছিল। পরে তাঁরা জানতে পারেন, গতকাল বিকেলে সেখানে রেশমার মৃত্যু হয়।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) আমেনাদের ঘরের বাইরে চেয়ারে বসেছিলেন আমেনার স্বামী মো. ইকবাল, আমেনার ছোট ভাই মো. ইয়াকুব, বড় বোনের স্বামী মো. আইয়ুব খান এবং দেবর মো. জাহাঙ্গীর আলম। সবাই আমেনার স্বামী ইকবালকে ঘিরে বসেছিলেন।
এ সময় ইকবাল বলেন, ‘আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে, নাতিরে বাসচাপা দিয়ে খুন করা হইছে। আমার মেজ মেয়ে অনামিকার অবস্থাও খুব খারাপ। কারা, কেন ওদের খুন করল।’
তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর সব জায়গায় সংস্কার হচ্ছে। সড়কে কোনো সংস্কার নাই। প্রতিনিয়ত মানুষ মরছে। এ ব্যাপারে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমি সব হারাইছি। আর কেউ যেন কারও একজনও আপনজন না হারায়। আমি সরকারসহ সবার কাছে আমার স্বজনদের হত্যার বিচারসহ সড়কপথ নিরাপদ করার দাবি জানাই।’
বাসচাপার ভিডিওটি দেখার পর এটিকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলেছেন নিহত আমেনা আক্তারের দেবর জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, ‘বাসটি যদি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থাকে, তাহলে যাত্রীদের বাঁচাতে টোল প্লাজার অন্য কোথাও মেরে দিতে পারত অথবা টোলপ্লাজার অন্য লেনে গাড়ি ছিল না সেখান দিয়ে যেতে পারত। টোল প্লাজায় আসলে বাসের গতিও স্বাভাবিক থাকত। কিন্তু সেখানে টোল প্লাজার দিকে আসার পর, বাসের গতি এত বাড়ল কেন? বাসটিকে গাড়িগুলোর ওপরেই কেন উঠিয়ে দিতে হলো? আমরা বিভাগীয় তদন্তসহ ব্যবস্থা চাই।’
মামলা ও আটক : দুর্ঘটনার পর নিহত আমেনা আক্তারের বড় ভাই নুরুল আমিন বাদী হয়ে হাসাড়া হাইওয়ে থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। এতে বাসের অজ্ঞাত মালিক, চালক ও তাঁর সহকারীকে আসামি করা হয়েছে। বিকেল পৌনে চারটা পর্যন্ত মামলা প্রক্রিয়াধীন ছিল। বাসচালককে র্যাব হেফাজতে নিয়েছে।
হাসাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের জিলানি শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) বেলা পৌনে চারটার দিকে বলেন, ‘আমরা কাউকে আটক করিনি। শুনতে পেয়েছি র্যাব-১০ বাসটির চালককে আটক করেছে। তবে ঘটনাটি কী কারণে ঘটেছে, সেটি উদ্ঘাটনে কাজ চলছে।
এ ছাড়া বাসের ফিটনেস ছিল কি না, চালকের ভারী যান চালানোর লাইসেন্স ছিল কি না, চালক পর্যাপ্ত বিশ্রাম পেয়েছিলেন কি না, চালককে হেফাজতে পেলে জানা যাবে।’ সূত্র : প্রথম আলো
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :