ছাড়া হচ্ছে তিস্তার পানি, বোরো মৌসুমে সেচ পাবে ৫৫ হাজার হেক্টর জমি

  • নীলফামারী প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৫, ০৭:১৪ পিএম
ছাড়া হচ্ছে তিস্তার পানি, বোরো মৌসুমে সেচ পাবে ৫৫ হাজার হেক্টর জমি

নীলফামারী: দেশের উত্তরাঞ্চলে সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ কমান্ড এলাকার সেচ সক্ষমতা বাড়াতে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আগামী ২০২৭ সালের জানুয়ারি থেকে কমান্ড এলাকার কৃষকরা এক লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ পাবেন। 

পাশাপাশি যে সকল এলাকায় সেচ খালের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে, সে সকল এলাকার ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে চলতি বোরো মৌসুমে সেচ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)।

বাপাউবো সূত্র মতে, সেচ প্রকল্পের খাল নীলফামারীর ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারাজ থেকে শুরু হয়ে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২টি উপজেলায় বিস্তৃত। মোট সেচ খালের দৈর্ঘ্য ৭৬৬ কিলোমিটার। উত্তরাঞ্চল খরাপ্রবণ এলাকা হওয়ায় তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারেজ নিমার্ণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। 

তবে এর মূল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৭ সালে নির্মাণ কাজ শুরু পরিকল্পনা থাকলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীগণ সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি এবং জনবল দ্বারা নতুন জরিপ ও বিস্তারিত পরিকল্পনা ও ডিজাইন প্রণয়ন করে মডেল স্টাডির ভিত্তিতে তিস্তা
ব্যারাজ এর বর্তমান স্থান নির্ধারণ করেন। 

এরপর তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ ১৯৭৯ সালে এবং ক্যানেল সিস্টেমের নির্মাণ কাজ ১৯৮৪-৮৫ সালে হাতে নেয়া হয়। জুন ১৯৯৮ প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। তিস্তা ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৬১৫ মিটার, গেট ৪৪ টি। ক্যানেল হেড রেগুলেটর ১১০ মিটার দীর্ঘ, গেট ৮টি। সর্বমোট গেট ৫২টি।

জানা যায়, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প (ফেজ-১) সেচ সুবিধার আওতায় আনা হয় নীলফামারী জেলার ৫টি উপজেলা- সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুর জেলার ৪টি উপজেলা- সদর, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, দিনাজপুর জেলার ৩টি উপজেলা- চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, খানসামা। 

প্রধান খাল ৩৩ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার, মেজর সেকেন্ডারী খাল (দিনাজপুর ও রংপুর) ৭৪ দশমিক ৪৩ কি. মি. শাখা খাল/ সেকেন্ডারী খাল ২১৪ দশমিক ৭০কিলোমিটার, উপ-শাখা খাল/টারশিয়ারী খাল ৩৮৭ দশমিক ৬৫ কি. মি. নিষ্কাশন খাল ৩৮০ কি.মি.। প্রধান খালে পানি সরবরাহ ক্ষমতা ২৮৩ কিউসেক।

প্রায় সকল খাল নীলফামারী জেলার উপর দিয়ে রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় গেছে। ১ম পর্যায়ের সেচ যোগ্য এলাকা ১,১১,৪০৬ হেক্টর ধরা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছিল ৯১,২২৬ হেক্টর। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সংস্কার কাজ না করার কারণে গড়ে ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার হেক্টরের বেশি জমি সেচ পেতো না।

সেচের সক্ষমতা বাড়াতে নতুনরূপে সংস্কারের কাজ হাতে নেয়া হয়। যার কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের জুলাই থেকে। বাপাউবো সূত্র মতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হবার কথা ছিল। মোট বরাদ্দ ধরা হয় এক হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। বলা হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) “তিস্তা সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন, সংস্কার ও পরিবর্ধন প্রকল্প” এটি।

প্রকল্পের অধীনে সেচ প্রকল্পের সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ চলমান। বিভিন্ন কারণে সময় মতো সংস্কার কাজ পিছিয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ এবার বৃদ্ধি করে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আবারও আগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

তারা বলছেন মূলত বর্ষাকালে অনাবৃষ্টির ফলে খরা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এই প্রকল্প হলেও নতুন করে আমূল সংস্কারের কাজ শেষে ২০২৭ সাল থেকে শুষ্ক মৌসুমেও বোরো চাষের জন্য সেচ পাবে পুরো প্রকল্প এলাকার কৃষক। এ জন্য তিস্তা ব্যারাজের উজানে খননের আরও একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে আরও প্রায় ৫০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে। বাপাউবোর উত্তরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পটি বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতার আংশিক ব্যবহার করে উত্তরাঞ্চলের রংপুর,
দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২টি উপজেলায় সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। 

নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর সক্ষমতা বহুলাংশে বাড়বে। তিনি জানান, বর্তমানে তিস্তা নদীতে প্রায় পাঁচ হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। তাই এবার আমরা বোরো মৌসুমে ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য প্রতিটি কমান্ড এলাকায় কৃষকদের সাথে বৈঠক করছি। কোনো এলাকায় কি পরিমাণ সেচ প্রয়োজন সেটি জানার পর আমরা সেচ ব্যবস্থা পরিচালনা করবো।

আগামী ১৫ জানুয়ারী থেকে সেচ কার্যক্রম শুরু করা হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, তিস্তা সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন, সংস্কার ও
পরিবর্ধন প্রকল্প ৩৯টির শেষ হওয়ার সময় ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এটি এখন দুই বছর সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজ শেষ হলে ২০২৭ সালের জানুয়ারী থেকে এক লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে।

এদিকে তিস্তা কমান্ড এলাকা কৃষকরা জানান, বর্ষায় ব্যারাজের সক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি আসায় বন্যা ও ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকল্প ও প্রকল্প এলাকার মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমের পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় খরায় পোড়ে ফসল। ৯০-এর দশক থেকে অভিন্ন এই নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে উজানের প্রতিবেশী দেশ ভারত।

তিস্তা সেচ প্রকল্পের কৃষকরা জানান, অনাবৃষ্টি ও খরার সময় তিস্তা সেচ আমাদের আর্শিবাদ বয়ে আনে। আমন ধান মূলত বৃষ্টি নির্ভর আর বোরো ধান সেচ নির্ভর। প্রতি একরে সেচ খরচ মাত্র ১৮৯ টাকা।

জলঢাকা উপজেলা শৈলমারী তিস্তা সেচ এলাকার কৃষক শেখ আলী(৫৫) বলেন, এবছর আমি সাড়ে ৩ একর জমিতে আমন চারা রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

কিন্তু গত বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় শঙ্কায় ছিলাম। ডিসেম্বরে পানি উন্নয়নের বোর্ডে মাঠ বৈঠকে আশ্বাস দেয়া হয় প্রতিবছরের মতো এবার সেচ ক্যানেলে পানি দেয়া হবে। এটি শোনার পর কিছুটা নিশ্চিত হই। একই উপজেলার বালাগ্রাম এলাকার কৃষক আব্দুল গাফফার (৬০) বলেন, গত মৌসুমে আমার ৩ একর জমিতে আমন চারা রোপণ নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম।

পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা সেচ প্রকল্পে সম্পূরক সেচ শুরু করলে নিশ্চিন্ত হই। কৃষকরা বলেন, তিস্তা সেচ প্রকল্পের অধীন পুরাতন ও ক্ষতিগ্রস্ত সেচ নালা সংস্কার ও পুনর্বাসনের ব্যাপক কাজ চলমান রয়েছে। এসব কাজ শেষ হলে আগামীতে আরও বেশি এলাকা সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। 

এদিকে তিস্তা প্রকল্পের সুবিধাভোগী কৃষকরা জানায়, নদীতে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন প্রবাহ ঠিকঠাক থাকলে বোরো আবাদে সেচ পেতে কোনো সমস্যা হবে না। পাশাপাশি তিস্তা কমান্ড এলাকায় বোরো আবাদেও তিস্তার সেচে বাম্পার ফলন হয়ে থাকে।

রংপুর কৃষি অঞ্চল কার্যালয় সুত্রে জানানো হয়, এবছর চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৭৪৬ হেক্টরে, গাইবান্ধায় ১ লাখ ২৯ হাজার ১৫ হেক্টরে, কুড়িগ্রামে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৬০ হেক্টরে, লালমনিরহাটে ৪৮ হেক্টরে ও নীলফামারী জেলায় ৮১ হাজার ৮৯৭ হেক্টরে। 

এই পরিমাণ জমিতে বোরো আবাদের জন্য ২৬ হাজার ৫৯২ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো আবাদ হলে রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলায় ২২ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৫ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হবে।

এআর

Link copied!