শিশুর বিকাশে জায়গার আকাল

  • চট্টগ্রাম প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ৪, ২০২৫, ১১:১২ এএম
শিশুর বিকাশে জায়গার আকাল

চট্টগ্রাম : স্বাধীনতার ৫৫ বছরেও চট্টগ্রামে কোনো পরিকল্পিত বিনোদনকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। শুধু কি পরিকল্পিত? কোনো বিনোদনকেন্দ্রই গড়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত গড়ে উঠলেও তা বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে সরকারি সংস্থার বিক্ষিপ্ত জায়গায় কয়েকটি শিশুপার্ক গড়ে উঠলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেগুলোও বন্ধ। 

আর এতে শিশুদের মনোবিকাশের জায়গা যেমন নেই- তেমনিভাবে বিনোদনকেন্দ্রের ঘাটতিতে প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে মানুষ। আর এতে আমাদের শিশুরা ব্যতিক্রমী আচরণ ধারণ করে বড় হচ্ছে।

শিশুদের মনোবিকাশের জন্য অবশ্যই পাড়ায় পাড়ায় শিশুপার্ক ও খেলার মাঠ যেমন প্রয়োজন, তেমনিভাবে একটি শহরের আইকনিক শিশুপার্কও প্রয়োজন। যা এই শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করবে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রুমানা আক্তার বলেন, ‘শিশুদের বুদ্ধির বিকাশ হয়ে থাকে খেলাধুলার মাধ্যমে। শিশুপার্ক ও খেলার মাঠে শিশুরা শারীরিক কসরতের মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্যের যেমন বিকাশ ঘটায় তেমনিভাবে বুদ্ধিরও বিকাশ ঘটায়। এখন আমাদের শিশুরা এর কোনোটাই না পেয়ে ব্যতিক্রমী আচরণ করে থাকে। ডিভাইস ব্যবহারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

এই শহরে কি শিশুপার্ক নেই?

এই প্রশ্নের উত্তর— অবশ্যই নেই। স্বাধীনতা-উত্তর এই শহরে শিশুদের বিকাশের জন্য তেমন কোনো ‘চিলড্রেন্স পার্ক’ গড়ে উঠেনি। গণপূর্ত অধিদপ্তরের মালিকানাধীন আগ্রাবাদে জাম্বুরি মাঠের একাংশে কর্ণফুলী শিশুপার্কের জন্য ১৯৯১ সালে ৯ একর জমি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে ইজারা দেওয়া হয়। এতে ২০০০ সালে পার্ক নির্মাণ করে আনন্দমেলা লিমিটেড। কিন্তু গত ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেটি বন্ধ।

২০০৬ সালে ১১ একর জায়গার ওপর বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনার রেপ্লিকা নিয়ে নগরের চাদগাঁওয়ে তৈরি করা হয় জিয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স। পরে যা স্বাধীনতা কমপ্লেক্স নাম ধারণ করে। এই কমপ্লেক্সে সংসদ ভবন, শহীদ মিনার, সোনা মসজিদ, কান্তজির মন্দির, আহসান মঞ্জিল, সুপ্রিম  কোর্ট ও স্মৃতিসৌধের রেপ্লিকা রয়েছে।

পার্কের মূল আকর্ষণ ছিল প্রায় ২০০ ফুট উঁচু টাওয়ারে থাকা ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁ। ২৩ তলা উচ্চতায় অবস্থিত এই রেস্তোরাঁ থেকে এক নজরে পুরো চট্টগ্রাম শহর ও কর্ণফুলী নদী দেখার সুযোগ ছিল। এ ছাড়া ১৫টির  বেশি রাইড, ছোট-বড় রেস্তোরাঁ ছিল পার্কের ভেতর। এটিও গত ৫ আগস্টের পর বন্ধ।

এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর অভ্যন্তরে কাজীর দেউড়ি এলাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জায়গায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে পার্ক করার জন্য বরাদ্দ দিয়েছিল। জিয়া স্মৃতি শিশুপার্ক নামের সেই পার্কটি ২০২৩ সালে সরকার উচ্ছেদ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে জায়গা বুঝিয়ে দেয়। ফলে কার্যত বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে কোনো শিশুপার্ক নেই। 

একটি কেন্দ্রীয় পার্ক গড়ে ওঠেনি কেন?

চট্টগ্রাম শহরের পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন স্থপতি জেরিনা হোসেন। ‘পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের’ একনিষ্ঠ এই সদস্য সম্প্রতি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বোর্ড সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।

পার্ক গড়ে না ওঠার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই শহরে এমন অনেক কিছুই গড়ে ওঠেনি। যেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একটি পার্ক হতে পারত, সিডিএর প্রতিটি আবাসিক এলাকায় পার্ক হতে পারত, থাকতে পারত খেলার মাঠ। কিন্তু তা হয়নি। একইভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে বিভিন্ন বয়স গ্রুপের একটি আইকনিক পার্ক বা বিনোদনকেন্দ্রও গড়ে উঠতে পারত।’

২০০৬ সালের দিকে সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শাহ মুহম্মদ আখতার উদ্দিন চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ ডোবা (বিশাল জলাধার), রেলওয়ের জোড়া দিঘি, ভেলুয়ার দিঘি এবং আসকার দিঘিকে কেন্দ্র করে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার নকশা করেছিলেন। কিন্তু এই জলাধারগুলোর মধ্যে আসকার দিঘি ছাড়া বাকিগুলো ছিল রেলওয়ের মালিকানাধীন। এক সংস্থার মালিকানাধীন জায়গা ও ব্যক্তির মালিকানাধীন জায়গা রাষ্ট্রের বিনোদন কেন্দ্রের জন্য বরাদ্দ দেবে কেন?

আর এই জটিলতায় গত দুই দশকেও চট্টগ্রাম শহরে কোনো বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠেনি। এরমধ্যে ২০০৬ সালে রেলওয়ের মালিকানাধীন ফয়’স লেককে কেন্দ্র করে কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ড গড়ে তোলা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩০ বছর এই প্রকল্প কনকর্ড পরিচালনা করার পর রেলওয়ের আওতায় আসবে। আর এখানে প্রবেশমূল্য বেশি হওয়ায় সাধারণের জন্য তা বহন অসাধ্য। 

আগামীর পরিকল্পনা কী?

চট্টগ্রাম শহর নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করছে সিডিএ। এ বিষয়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক ও উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী বলেন, আমরা চট্টগ্রাম শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ ও পার্ক গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ রাখছি। একই সঙ্গে এই প্রকল্পটি কোন সংস্থা বাস্তবায়ন করবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছি। এতে নগরে শিশুদের মানসিক বিকাশের জায়গা পাওয়া যাবে।’

তিনি আরও বলেন, আমরা চট্টগ্রাম শহরের বড় আকারের জলাধার বা দিঘিগুলোকে একটি প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করে তা বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। এই প্রস্তাবনাও আমাদের মাস্টারপ্ল্যানে দেওয়া হবে। আর তা করা গেলে জলাধারগুলো যেমন রক্ষা পাবে তেমনিভাবে নগরীর অক্সিজেনখ্যাত এসব জলাধার ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘ আমরা সড়ক বা অন্যান্য প্রকল্পের জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করি। কিন্তু শিশুদের জন্য কোনো বিনিয়োগ করি না। এর মাধ্যমে আমরা সেই বিনিয়োগ নিশ্চিতের আহ্বান করব।’

শিগগিরই চালু হবে বন্ধ হয়ে যাওয়া দুই শিশুপার্ক

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আগ্রাবাদ কর্ণফুলী শিশুপার্ক পরিচালনার জন্য আমরা নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করছি। আর স্বাধীনতা কমপ্লেক্সটি সিটি করপোরেশনকে পরিচালনার জন্য বরাদ্দ দিতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি লেখা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এ বিষয়ে সমাধান পাওয়া যাবে।’

তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে এখন সবার ভাবনার বিষয় বিনোদনকেন্দ্র। এই নগরে সিটি করপোরেশনের আওতায় নির্মাণ হতে যাওয়া বাড়ই পাড়া খালের উভয়পাড়ে বিনোদন কেন্দ্র থাকবে। এছাড়া সিডিএর আওতায় নির্মাণাধীন কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে শাহ আমানত সেতু থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠবে। এছাড়া আগামীতে বড় আকারেও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে। 

এমটিআই

Link copied!