ফের বেড়েছে ছিনতাই

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২০, ০৪:০০ পিএম
ফের বেড়েছে ছিনতাই

ঢাকা : হঠাৎ করেই বেড়েছে ছিনতাই। প্রতিদিনই রাজধানীজুড়ে ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে টার্মিনাল ও বাস স্টপেজকেন্দ্রিক ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য চরম আকারে পৌঁছেছে। রাজধানীর অভ্যন্তরীণ বাস স্টপেজগুলোতে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা অহরহ মোবাইল ছিনতাই করছে।

এছাড়াও ভোর ও সন্ধ্যার পর থেকে বিভিন্ন রাস্তায় ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। গত ৮ ডিসেম্বর ছিনতাইকারীদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে আবদুল্লাহপুরে জিসান নামের এক যুবক মারা যান। পরে এ ঘটনায় পুলিশ ৯ ছিনতাইকারীকে আটকও করে।

পুলিশ বলছে, ছিনতাই প্রতিরোধে ইতিমধ্যে নগর গোয়েন্দা ও থানা পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুরো রাজধানীকে ৬ ভাগে ভাগ করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আর ৬ স্থানকে ছিনতাইয়ের ডেঞ্জার জোন বলা হচ্ছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও এসব ডেঞ্জার জোনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছিনতাই প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি এক রাতে একই সঙ্গে রাজধানীতে অন্তত তিনটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুজন গণমাধ্যমকর্মী ছিনতাইয়ের শিকার হন। একজন দৈনিক ভোরের কাগজের সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার দেব দুলাল মিত্র, অন্যজন আরটিভি অনলাইনের স্টাফ রিপোর্টার মিথুন চৌধুরী। এছাড়া আরেকজন উত্তরার মিরাজ শিকদার।

রাত একটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদ এলাকায় ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন ভোরের কাগজের সাংবাদিক দেব দুলাল মিত্র। তার গলায় ছুরি ধরে ছিনতাই করা হয়।

দেব দুলাল মিত্র বলেন, ‘রাতে ধানমন্ডির শংকর বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। পশ্চিম ধানমন্ডি জামে মসজিদ পার হওয়ার পর বিপরীত দিক থেকে রিকশায় আসা দুই ছিনতাইকারী আমার পথ রোধ করে।

কিছু বুঝে ওঠার আগে এক যুবক গলায় ছুরি ধরে, অন্যজন পকেট থেকে মানিব্যাগ ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। মাত্র ৪০ সেকেন্ডের ব্যবধানে রিকশাসহ ছিনতাইকারীরা সটকে পড়ে। এ ঘটনায় পরদিন সকালে মোহাম্মদপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল লতিফ বলেন, ‘পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আশপাশের সিসি ক্যামেরা খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে।’

রাজধানীর মগবাজার রেললাইন ধরে রাতে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির সংবাদকর্মী মিথুন চৌধুরী। তার চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে পকেটে থাকা ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে চিৎকার করে ছিনতাইকারীকে ধরার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয়নি। এরপর মগবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে এক দোকানে গিয়ে চোখ-মুখে পানি দিয়ে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করেন তিনি।

মিথুন বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে কারওয়ান বাজার থেকে রেললাইন ধরে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ পেছন থেকে এসে আমার চোখে শুকনো মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয় কেউ। এরপর মুহূর্তের মধ্যে আমার পকেটে থাকা ১৫ হাজার টাকা কেড়ে নেয়। প্যান্টের অন্য পকেটে থাকা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও আমার বাধার মুখে ব্যর্থ হয়।’

ওই সময় আশপাশে অনেকে চলাচল করলেও চিৎকারে কেউ এগিয়ে যায়নি বলেন জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, ‘এলাকায় প্রায়ই ছোটখাটো চুরির ঘটনা ঘটে। এলাকায় পুলিশি টহল থাকলেও তারা নিরাপত্তা দিতে পারছে না। পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো দরকার।’

এ ব্যাপারে হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহীউদ্দিন ফারুক বলেন, ‘আমরা ছিনতাইয়ের ঘটনাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছি। পুরো ঘটনাটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে গত ৯ ডিসেম্বর ছিনতাইকারীর উপর্যুপুরি ছুরিকাঘাতে উত্তরায় জিসান নামের এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ৯ জন ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশ।

এরা হলো সুন্দরী সুমন, স্বপন, মো. বিপ্লব, তৈয়ব আলী ওরফে উজ্জ্বল ওরফে তবলা ওরফে বাবলা, মো. জাহাঙ্গীর ব্যাপারী ওরফে হূদয়, মো. তানভীর রহমান নেহাল, মো. জিহাদ, নূরুল ইসলাম রাব্বি ও মো. রাকিব।

জানা যায়,  জিসান নোয়াখালী সোনাইমুড়ী খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। গত ২৮ নভেম্বর জিসান নোয়াখালী থেকে ধামরাইয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা বেলায় জিসান এক আত্মীয়কে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে যান। সেখান থেকে রুহুল আমিন নামের এক আত্মীয়ের সঙ্গে ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাস যোগে নবীনগর ফিরছিলেন।

তাদের বহনকৃত বাসটি আবদুল্লাহপুর এলাকায় আসলে জানালা দিয়ে এক ছিনতাইকারী জিসানের মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। দ্রুত বাস থেকে নেমে দৌড়ে ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেন তিনি। এ সময় রুহুলও বাস থেকে নেমে সেখানে যান।

এরপর তারা দুজন ছিনতাইকারীর কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করতে গেলে পেছন থেকে অপর দুজন ছিনতাইকারী এসে জিসান ও রুহুলকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। তাদেরকে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। পরে আহত জিসান ও রুহুলকে চিকিৎসার জন্য শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক জিসানকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।

উত্তরা বিভাগের ডিসি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় এ ঘটনায় জড়িত অভিযুক্তদের শনাক্ত করে গত ১২ ডিসেম্বর উত্তরা ও টঙ্গী এলাকা থেকে সুন্দরী সুমন ও স্বপনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তাদের হেফাজত থেকে হত্যায় ব্যবহূত ছুরি উদ্ধার করা হয়। তাদেরকে বিজ্ঞ আদালতের আদেশে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের সহযোগীদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নরসিংদীর রায়পুরা থানার বাঘাইকান্দী চর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঘটনার সাথে জড়িত মো. বিপ্লব ও তৈয়ব আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অব্যাহত অভিযানে উত্তরা ও টঙ্গী এলাকা থেকে ঘটনায় জড়িত মো. জাহাঙ্গীর ব্যাপারী, মো. তানভীর রহমান নেহাল, মো. জিহাদ, নূরুল ইসলাম রাব্বি ও মো. রাকিবকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তিনি আরো বলেন, গ্রেপ্তাররাসহ পলাতক অভিযুক্ত কবির ও নাতি সোহাগ আবদুল্লাহপুরসহ উওরা এলাকায় ছিনতাই করে। ঘটনার দিন জিসানের মোবাইল ছিনতাই করে পালানোর সময় জিসান ও রুহুল বাস থেকে নেমে ছিনতাইকারী হূদয়কে ধরে ফেললে দলের গ্রেপ্তার অন্য সদস্যরা হূদয়কে ছাড়ানোর জন্য আসে।

এ সময় ছিনতাইকারীরা এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে জিসান ও রুহুল আমিনকে রক্তাক্ত জখম করে পালিয়ে যায়।

তিনি বলেন, ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা একত্রে টঙ্গী ও আবদুল্লাহপুর এলাকায় ছিনতাই করে থাকে। দলের একটি গ্রুপ বিভিন্ন স্থানে পাহারা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যরা আশপাশে আসছে কিনা। গ্রুপের কোন একজন ধরা পড়লে গ্রুপের অন্য ৩ থেকে ৪ জন সদস্য মুরুব্বী সেজে ঘটনাস্থলে আসে এবং ‘কি হয়েছে ভাই’ ইত্যাদি কথা বলে আটক ছিনতাইকারীকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।

অন্যদিকে পুলিশ জানায়, সম্প্রতি রাজধানীর ৬ টি এলাকায় বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এ সব এলাকাগুলো হলো মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রমনা, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ি ও শেরে বাংলানগর। এই ৬ জোনে বিভক্ত করে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবিদ হাসান জানান, রাজধানীর ছিনতাই প্রতিরোধে থানা পুলিশকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!