সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের হাতে চোরাই মোবাইল সেট

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১, ০১:২৯ এএম
সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের হাতে চোরাই মোবাইল সেট

ঢাকা : আমদানি করা চোরাই মোবাইল সেট এখন সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের হাতে। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে এ ধরনের মোবাইল সেট ব্যবহার করেছে তারা। চোরাইপথে আনা মোবাইল সেটগুলোয় ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি অর্থাৎ আইএমইআই নম্বর থাকে না।

আবার দেখা যাচ্ছে, একই আইএমইআই নম্বর শত শত মোবাইল সেটে থাকছে; যার কারণে দাগি অপরাধী শনাক্তে বিপাকে পড়তে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অধরাই থেকে যাচ্ছে দাগি সন্ত্রাসীরা।

সম্প্রতি আইএমইআই নম্বর পাল্টে দেওয়া একটি চক্রকে গ্রেপ্তারও করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। তাদের নিকট থেকেও পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে এক শ্রেণির চক্র, বিশেষ করে চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোবাইল সেট পাচার করছে। পরে সেগুলো রাজধানীর অভিজাত মার্কেট থেকে শুরু দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এই সেটগুলো নিজেকে লুকিয়ে ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে সন্ত্রাসী দাগি আসামিরা ব্যবহার করছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমস, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) যৌথ অভিযান চালিয়ে গত কয়েক মাসে এ ধরনের কয়েক হাজার মোবাইল সেট উদ্ধার করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে সম্প্রতি চীন থেকে আনা প্রায় ২২ হাজার মোবাইল সেট জব্দ করে কাস্টমস। সংস্থাটি কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখে এই বিপুল পরিমাণ মোবাইল সেট আমদানির ক্ষেত্রে বিটিআরসির কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি মোবাইলগুলোর কোনো আইএমইআই নম্বরও নেই।

এ ছাড়া যেগুলোর আইএমইআই নম্বর আছে সেগুলোতে একই নম্বরের অনেক সেট রয়েছে।

সূত্র জানায়, মোবাইলের যন্ত্রাংশ ঘোষণা দিয়ে আনা এই সেটগুলোর যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে তাও ভুয়া। পরবর্তীসময়ে গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি নিয়ে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করলে এর প্রমাণ পায়। দেখা যায় চোরাইপথে আনা মোবাইল সেটগুলোর আইএমইআই নম্বর থাকে না। আবার যেগুলোর থাকে সেগুলোর একই নম্বরে অনেক মোবাইল সেট থাকে।

অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থা বুঝতে বাকি থাকে না সাধারণত অপরাধমূলত কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করার জন্য সেটগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহকরাও এই  মোবাইলগুলো কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে জানা যায়, সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাগি আসামি গ্রেপ্তারে প্রযুক্তির সহায়তা অপারেশন শুরু করে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথ্য বিভ্রাটের মধ্যে পড়ে যায়। পরে বিটিআরসির সহযোগিতা চাইলেও তারা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। পরে পুলিশ বিটিআরসির বিরুদ্ধে সহযোগিতা না করার অভিযোগও তোলে।

এরপরই বিটিআরসির কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। বিটিআরসি তদন্ত করে দেখে একই আইএমইআই নম্বরের মোবাইল সেট শত শত। আবার দেখা যাচ্ছে কোনো মোবাইল সেটের আইএমইআই নম্বরই নেই। পরে বিটিআরসি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সহযোগিতা নিয়ে দেশব্যাপী অভিযানে নামে।

সম্প্রতি রাজধানীর বসুন্ধরা সিটিতে অভিযান চালিয়ে এ ধরনের কয়েক হাজার মোবাইল সেট জব্দ করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, একজন অপরাধী কখনোই তার নিজের পরিচয়পত্র দিয়ে মোবাইলের সিম কেনে না। পাশাপাশি সে যে মোবাইল সেট ব্যবহার করে তার ওপর ভিত্তি করে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতিনিয়ত সমস্যার সন্মুখীন হতে হচ্ছে। অবশ্য এ ধরনের সেট ব্যবহার করছে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন অপরাধীরা।

বর্তমানে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অধিকাংশই তরুণ এবং যুবক। যারা প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন। মূলত এদের মোবাইল নম্বর ও মোবাইল সেট কোনোটিরই সঠিক তথ্য থাকছে না। বিষয়টি অনুধাবন করেই এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে।

রুট শাহজালাল : গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যমতে চোরাই মোবাইলের রুট হচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এক শ্রেণির সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দিয়ে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে তারা এসব মোবাইল আমদানি করে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

সূত্র জানায়, আইএমইআই না থাকা ও তা একাধিক থাকা মোবাইল সেটগুলোর মধ্যে রয়েছে-স্যামসাং, সনি, সনি এক্সপেরিয়া প্রভৃতি। সূত্রমতে, এই সেট আমদানিতে কোম্পানির কিছু অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত।

ঢাকা কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা মাহবুব হাসান বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা খবর পাই মোবাইলের যন্ত্রাংশ ঘোষণা দিয়ে মোবাইল আমদানি করে তা খালাসের চেষ্টা করছে একটি চক্র। পরে আমরা তল্লাশি চালিয়ে সেটি জব্দ করি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শাহজালাল বন্দরের কুরিয়ার বা ফ্রেইট দিয়ে এসব মোবাইলের চালান বের হওয়া সম্ভব নয়। বিমানবন্দর ব্যবহার করে লাগেজ সুবিধা নিয়ে কেউ করতেও পারে। তবে আমরা সব সময় সতর্ক থাকি যেন চোরাচালান পণ্য কোনোভাবেই বের হতে না পারে। পাশাপাশি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে যেন কোনো পণ্য বের হয়ে না যায়।

বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ সেটের আইএমইআই ঠিক থাকে না। দেখা যায় একাধিক সেটে একই আইএমইআই নম্বর। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধে এসব মোবাইল সেট ব্যবহার হয়, যার কারণে আমরা এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।

কাউন্টার টেরোরিজমের পুলিশ সুপার ছানোয়ার হোসেন বলেন, একই নম্বরের আইএমইআই যখন একাধিক হয় তখন সেটাকে ক্লোন বলে। আর এই ক্লোন সেট বিশেষ করে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন অপরাধীরা ব্যবহার করছে। আইএমইআই নম্বর না থাকা ও তা একাধিক থাকার কারণে  অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে সমস্যা হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। পাশাপাশি আইএমইআই নম্বর না থাকা ও তা একাধিক থাকা নম্বরের ব্যক্তিকে আমরা গ্রেপ্তারও করেছি।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, বিটিআরসির সহযোগিতায় আমরা এ ধরনের সেটের বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করেছি। মূলত অপরাধীরা তাদের নিজেকে লুকিয়ে রাখতে এ ধরনের সেট ব্যবহার করছে।

আইএমইআই পাল্টে দেওয়া চক্র গ্রেপ্তার : এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চুরি বা ছিনতাই হওয়া মোবাইলগুলো তাদের কাছে আসত। পরে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে সেসব মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর বদলে বিক্রি করত চক্রটি।

র‌্যাব বলছে, আইএমইআই নম্বর বদলানো হলে চোরাই মোবাইল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। গ্রেপ্তাররা রাজধানীর চোরাই মোবাইল সংগ্রহ করে এ কাজটি করত।

পল্টন ও তেজগাঁও এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে র্যাব জানায়, ওরা একটি বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে চোরাই মোবাইলের আইএমইআই নম্বর বদলে দিত। ওই মোবাইল দিয়ে পরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় আরো  কয়েকজনের বিষয়ে খতিয়ে দেখছে র্যাব।

গ্রেপ্তাররা হলেন-শফিকুল ইসলাম (২৫), মাসুদ আহমেদ রানা (৩২), মো. ইমন (২৩), সিরাজ আলি (৩০), রানা হাজরা (২৬) ও আলামিন (১৯)। তাদের কাছ থেকে একটি কম্পিউটার, সাতটি মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের সফটওয়্যার, ২০টি মোবাইল ও নগদ ৬৬,৮৫০ টাকা উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব ১০-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান বলেন, মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করাটাই বড় অপরাধ। যে সফটওয়্যার তারা ব্যবহার করত তা কিন্তু চাইলেই ডাউনলোড করা যায় না। সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাও এর সঙ্গে জড়িত। যারা বাংলাদেশে এ কাজ করছে তারা প্রত্যেকেই অপতৎপরতায় লিপ্ত। পুরো কার্যক্রমটি অবৈধ।

মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, গ্রেপ্তাররা নিজেরাই ওই অ্যাপের মাধ্যমে চোরাই মোবাইলের আইএমইআই নম্বর বদলাত। এ চক্রের মধ্যে কয়েকজন ব্যবসায়ীও রয়েছে, যারা ওই সফটওয়্যার ও অ্যাপস সরবরাহ করত। তাদের বিষয়েও র্যাব নজরদারি বাড়িয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চালানো হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

Link copied!