স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ইপিআইয়ের পৃথক তদন্ত

গণটিকার কার্যক্রম থেকে ‘মডার্নার টিকা’ চুরি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২১, ১১:০৯ এএম
গণটিকার কার্যক্রম থেকে ‘মডার্নার টিকা’ চুরি

ঢাকা : গণটিকা চলার সময়ে কোনো একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মডার্নার টিকা চুরি করেছিলেন দরিদ্র পরিবার সেবা সংস্থা নামে ক্লিনিকের মালিক বিজয়কৃষ্ণ তালুকদার। আর সেই টিকাই তিনি ৫০০ টাকার বিনিময়ে দিয়ে আসছিলেন। আনুমানিক প্রায় ৫০০ ব্যক্তিকে তিনি এ টিকা দিয়েছেন।

পুলিশ বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিজয় কৃষ্ণ অনেক তথ্য দিয়েছে। তবে রিমান্ডে পেলে এ বিষয়ে পুরোপুরি তথ্য পাওয়া যাবে। তথ্যগুলো যাছাই-বাছাই করে পুরো সিন্ডিকেটটিকে আটক করা সম্ভব হবে। ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদনের শুনানি আগামীকাল সোমবার হবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪ নং ওয়ার্ডের উত্তরখান কলেজিয়েট স্কুলের কেন্দ্রের দায়িত্ব ছিলেন অভিযুক্ত বিজয় কৃষ্ণ তালুকদার। টিকা দেওয়ার দায়িত্বে ছিল দরিদ্র পরিবার সেবা সংস্থা ক্লিনিকের, যার মালিক বিজয় নিজে।

ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জয়নাল আবেদিন বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি এলাকায় বাবু নামে পরিচিত। গণটিকার ক্যাম্পেইন চলার সময় প্রতিদিন ৩৫০ জনকে টিকা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ২৫টি করে মডার্নার ভায়াল তার কেন্দ্রে নিতেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে ৫-৭ ডোজ কম হতো।

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ভায়ালে ১৪ জনকে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও বিজয় সব সময় কমবেশি করতেন। পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত থাকা ডোজগুলো রেখে কৌশলে বিক্রি করে দিতেন।

গত বুধবার রাতে রাজধানীর দক্ষিণখানের ওই ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে মডার্নার টিকার দুটি ভায়াল (প্রতি ভায়ালে ১০ ডোজ টিকা থাকে) এবং ভায়ালের ২০টি খালি বাক্সসহ পুলিশ বিজয়কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার করে।

অতিজরুরি এই টিকাও যে লোপাট করে কেউ ব্যবসা করতে পারে, তা দেখে এখন অবাক সবাই। পুলিশ বলছে, এই টিকা লোপাটের পেছনে আরো কয়েকজন জড়িত বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন বিজয়কৃষ্ণ।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় দক্ষিণখান থানার এসআই রেজিয়া খাতুন বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিজয়কৃষ্ণসহ অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। বিজয়কে জিজ্ঞাসাবাদে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হয়।

কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার এসআই আবদুল আজিজ বিচারালয়ে উপস্থিত না থাকায় বিজয়কৃষ্ণের রিমান্ডের বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ২৩ আগস্ট দিন ধার্য করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাঈদের আদালত। এরপর বিচারক বিজয়কৃষ্ণকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

দক্ষিণখান থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছয় দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনতে গত ৭ আগস্ট দেশজুড়ে শুরু হয় গণটিকাদানের বিশেষ ক্যাম্পেইন। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে দেওয়া হচ্ছিল মার্কিন কোম্পানি মডার্নার তৈরি টিকা।

আর ওই ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে গিয়েই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উত্তরার একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে মডার্নার কিছু টিকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন দরিদ্র পরিবার সেবা সংস্থা নামে ক্লিনিকের মালিক বিজয়কৃষ্ণ তালুকদার।

টিকা গ্রহণের জন্য যখন চারদিকে মানুষের মধ্যে তোড়জোড় চলছে, তখন সুযোগ বুঝে দক্ষিণখানের চালাবন হাজিপাড়া এলাকায় নিজ ক্লিনিকে বিনামূল্যের সেই টিকা ৫০০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি করছিলেন এই কথিত পল্লী চিকিৎসক। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, দরিদ্র পরিবার সেবা সংস্থা নামে ক্লিনিকটিতে অবৈধভাবে টাকার বিনিময়ে মডার্নার টিকা দেওয়া হচ্ছে বলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে অভিযান চালানো হয়। এসময় ক্লিনিকটিতে দুজন টিকা নিচ্ছিলেন।

একপর্যায়ে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্লিনিকের লোকজন পালিয়ে গেলেও ধরা পড়েন প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিজয়কৃষ্ণ। জব্দ করা হয় মডার্নার টিকার দুটি অ্যাম্পুল।

এর মধ্যে রোগীর বেডের নিচ থেকে একটি ও পরে বিজয়ের বাসায় শোবার ঘরে থাকা ফ্রিজের ভেতর থেকে অন্য অ্যাম্পুল জব্দ করা হয়। যার একটির মধ্যে টিকার আইসিক ছিল। এ ছাড়া ২০টি মডার্নার টিকার খালি বক্স পাওয়া যায় ওই ক্লিনিক থেকে।

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিজয়কৃষ্ণ জানান, তিনি ও তার সহযোগীরা পরস্পর যোগসাজশে চুরির মাধ্যমে আনা মডার্না টিকা অবৈধভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে সেগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন।

বিজয়কৃষ্ণকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে মডার্নার টিকায় সাধারণ মানুষের আস্থা বেশি।

এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নিবন্ধন করেও কাঙ্ক্ষিত টিকা না পাওয়ায় যেখানেই টিকার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, সেখান থেকেই তা নেওয়ার চেষ্টা করছে মানুষ। আর এ সুযোগ লুফে নিয়েছে কিছু অসাধু লোক। বিজয়কৃষ্ণ তাদেরই একজন। তিনি দরিদ্র পরিবার সেবা সংস্থা নামে ক্লিনিকটির মালিক। নিজেকে একজন পল্লী চিকিৎসক দাবি করলেও তিনি এ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

নিজ বসবাসস্থলে গড়ে তোলা তার ক্লিনিকে অবৈধভাবে মডার্নার টিকা বিক্রি করতেন তিনি। সেখানে একেকটি অ্যাম্পুল থেকে ১৪ জনকে টিকা দেওয়া হচ্ছিল। প্রতিডোজ টিকা দেওয়ার জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে বিজয় আদায় করতেন ৫০০ থেকে হাজার টাকা।

বিজয় উত্তরার একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে টিকাগুলো সংগ্রহ করেছেন বলে জানালেও ধারণা করা হচ্ছে, তিনি কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে টিকাগুলো চুরি করেছেন। এর সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক ব্যক্তি জড়িত।

জানা গেছে, দেশে করোনার টিকা আসার পর সেগুলো বিমানবন্দর থেকে সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমপ্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) নিজস্ব স্টোররুমে কঠোর নিরাপত্তায় সংরক্ষণ করা হয়।

ইপিআইয়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. মওলা বক্স চৌধুরী জানান, কীভাবে টিকা দরিদ্র পরিবার সেবা সংস্থায় গেল তা জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। এ ঘটনায় কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে গ্রহণ করা হবে কঠোর ব্যবস্থা ।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দক্ষিণখান থানার এসআই মো. আবদুল আজিজ জানান, অবৈধভাবে করোনা ভাইরাসের টিকা বিক্রি ও নিজ হেফাজতে রাখার অভিযোগে বিজয়কৃষ্ণ তালুকদারকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সরকারি এই টিকা কী করে বাইরে গেল, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিজয়কে রিমান্ডে পেলে কোথা থেকে তিনি ওই টিকা পেলেন এবং কতজনকে প্রয়োগ করেছেন তা বিস্তারিত জানা যাবে। এই চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে এ ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম গণমাধ্যমকে বলেছেন, টিকা উদ্ধারের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মূলে কারা থাকতে পারে, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। পুলিশ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। অধিদপ্তরের কারো সম্পৃক্ততা থাকলে তাও বের করা হবে।

ডিএমপি উত্তরা বিভাগের পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম।

তিনি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত ব্যক্তি সবকিছু স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন টিকাদান কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় সেখান থেকেই তিনি টিকা সরিয়েছিলেন। পরে কোনো ডোজ ৫০০ টাকা, আবার কোনো ডোজ ১০০০ টাকা করে বিক্রি করেছেন।

তিনি বলেন, ‘উত্তর সিটি করপোরেশনকে (ডিএনসিসি) আমরা অনুরোধ করেছি, ওই এলাকায় যে কেন্দ্রগুলো ছিল, সেখানকার টিকার খালি ভায়াল ও ডোজের হিসাব মেলানোর জন্য। তদন্তে সেটাও লাগবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!