তিন লাখ গ্রাহকের ৭৫০ কোটি টাকা হাওয়া

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১, ০১:১৫ পিএম
তিন লাখ গ্রাহকের ৭৫০ কোটি টাকা হাওয়া

ঢাকা : ইভ্যালির মতো আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা গ্রাহকের ৭৫০ কোটি টাকা গায়েব করে দিয়েছে। প্রায় ৩ লাখ গ্রাহকের এই টাকার কোনো হদিস নেই। ধারণা করা হচ্ছে, তারা অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছে বা মানি লন্ডারিং করেছে।

জানা গেছে, ধামাকা শপিং ডটকমের কোনো অনুমোদন ও লাইসেন্স নেই। ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট। ব্যবসা পরিচালনায় ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামে এক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা হতো। এ পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। সেই টাকার কোনো হদিস নেই। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ধামাকা ডিজিটাল ২০২০ থেকে ধামাকা শপিং ডটকম নামে কার্যক্রম শুরু করে। বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে ওই অ্যাকাউন্টে রয়েছে মাত্র লাখখানেক টাকা। শুধু তাই নয়, বর্তমানে সেলার বকেয়াই রয়েছে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা, গ্রাহকদের বকেয়া ১৫০ কোটি ও রিফান্ড চেক বকেয়া ৩৫-৪০ কোটি টাকা।

বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য দেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির সিইওসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তিনি বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কারসাজির মাধ্যমে লাখ লাখ গ্রাহককে পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে, যা দেশব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন আলোচনায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি উঠে এলে বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর পশ্চিম থানায় এক ভুক্তভোগী ‘ধামাকা শপিং ডটকম’র চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তাসহ (সিওও) ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।

র‌্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার প্রতিষ্ঠানটির তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয় ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার সিরাজুল ইসলাম রানা ধামাকার সিওও, ইমতিয়াজ হাসান সবুজ মোবাইল ফ্যাশন ও লাইফ স্টাইলের ক্যাটাগরি হেড এবং ইব্রাহীম স্বপন ইলেকট্রনিক্স ক্যাটাগরি হেড। গ্রেপ্তাকৃতরা ২০২০ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটি নেতিবাচক অ্যাগ্রেসিভ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে মাঠে নামে।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান বলেন, ধামাকার কোনো প্রকার অনুমোদন ও লাইসেন্স নেই। এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে তাদের। বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে তাদের অ্যাকাউন্টে মাত্র লাখখানেক টাকা রয়েছে। সেলার বকেয়া রয়েছে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা, কাস্টমার বকেয়া ১৫০ কোটি এবং কাস্টমার রিফান্ড চেক বকেয়া ৩৫-৪০ কোটি টাকা।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানিয়েছেন, আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং ডিপো ভাড়া বকেয়া রয়েছে। পাশাপাশি চলতি বছরের জুন মাস থেকে বকেয়া রয়েছে কর্মচারীদের বেতন। চলতি বছরের গত এপ্রিল থেকে ধামাকা শপিং ডটকম অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কারণে জুলাই থেকে সব কার্যক্রম বন্ধ।

ধামাকার ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, রাজধানীর মহাখালীতে তাদের প্রধান কার্যালয় এবং তেজগাঁও বটতলা মোড়ে একটি ডেলিভারি হাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৬০০টি ব্যবসায়িক চেইন রয়েছে। এর মধ্যে নামিদামি প্রতিষ্ঠানের নামও উঠে এসেছে।

ধামাকা শপিং ডটকম ছাড়াও তাদের আরো কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন-ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রোট্রেড ফুড এবং বেভারেজ লিমিটেড ও মাইক্রোট্রেড আইসিক্স লিমিটেড। মূলত প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া।

এছাড়া হোল্ড মানি প্রসেস প্ল্যান, অর্থাৎ গ্রাহক ও সরবরাহকারীর টাকা আটকে অর্থ সরিয়ে ফেলা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর নানা অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করা হতো।

ধামাকা শপিংয়ের গ্রাহক সংখ্যা ৩ লক্ষাধিক। মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, বাইক, গৃহস্থালিপণ্য ও ফার্নিচার বিভিন্ন অফারে বিক্রি করা হতো। অফারগুলোর মধ্যে সিগনেচার কার্ড ২০-৩০ শতাংশ, ধামাকা নাইটে ৫০ শতাংশ, রেগুলারে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হতো। সিগনেচার কার্ড অফারটি গত মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়। মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য সরবরাহ করে অর্থ সরিয়ে গ্রাহকদের চেক প্রদান করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে সব অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, ব্যবসায়িক কাজে ধামাকা শপিং ডটকম ইনভেনটরি জিরো মডেল এবং হোল্ড মানি প্রসেস প্ল্যান ফলো করত। কয়েকটি দেশি-বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে তাদের ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কোনো ইনভেস্টমেন্ট ছিল না।

এতো দিন ধরে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কীভাবে ব্যবসা করে আসছে জানতে চাইলে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, অক্টোবর মাস থেকে তারা অ্যাগ্রেসিভ বিজনেসে যায়। ধামাকা খুব অল্প সময়ই মোটা অংকের অর্থ সরিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ১৪টি অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে। সিআইডির তদন্তে উঠে আসে অসচ্ছতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করছে। যাদের বিরুদ্ধেই মামলা হচ্ছে, তারা যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গ্রাহকের ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হলেও ধামাকার অ্যাকাউন্টে মাত্র লাখখানেক টাকা থাকার বিষয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, ধামাকার ট্রেড লাইসেন্স নেই। সাধারণ গ্রাহকরা যে টাকা দিয়েছে তা গেছে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের অ্যাকাউন্টে। ধামাকার আরো অনেক ব্যবসা রয়েছে। সেসব ব্যবসায় সেই টাকা স্থানান্তর হয়েছে। টাকা আসলে কোথায় গেল তা মানি লন্ডারিং পর্যায়ে পড়েছে কি না তা শিগগির বেরিয়ে আসবে। মূলহোতা জসিম উদ্দিন চিশতির নিজস্ব সম্পদ রয়েছে আড়াইশ কোটি টাকার ওপর। সেখানেও ধামাকার গ্রাহকদের টাকা যেতে পারে।

ধামাকার প্রতারণার মূলহোতা জসিম উদ্দিন চিশতি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি পলাতক। আমরা জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারদের মাধ্যমে জেনেছি তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। তাকেসহ অন্য আসামিদের খুঁজছি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!