ঢাকা: দেশের অর্থনীতিতে বড় আতঙ্কের এক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘অলিগার্ক’। এ অলিগার্কের শীর্ষে অবস্থান করছেন দেশের আমলারা, দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছেন রাজনীতিবিদরা। গত রোববার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার দুর্নীতির বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বেশ কয়েকবার অলিগার্ক শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে।
অর্থনীতিতে গত ১৫ বছরে মাফিয়াতন্ত্রের রাজ বোঝাতে এ কমিটি অলিগার্ক শব্দটি ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছে দেশের অর্থনীতি এদের কবলে পড়ে এখন ‘কঙ্কালসার’। আর অলিগার্ক আমলাদের দুর্নীতির উৎস ছিল ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়’ (পিএমও)। উপকারের (দুর্নীতির সুযোগ) প্রতিদান হিসেবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে কারচুপির পূর্ণ সহযোগিতা করেন আমলারা। বাংলাদেশ নিয়ে মিথ ছিল শিগগিরই ‘মধ্যম আয়ের’ ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে দেশটি। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলছে, ইতিমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছে এ দেশ।
বাংলাদেশের খাতগুলোতে দুর্নীতি-অনিয়মের শীর্ষে রয়েছে ব্যাংক খাত, দ্বিতীয়ত অবকাঠামো খাত, তৃতীয়ত জ্বালানি ও চতুর্থ খাত হিসেবে রয়েছে আইসিটি। ব্যক্তিখাতের দুর্নীতিতে শীর্ষে রয়েছেন দেশের সরকারি চাকরিজীবী তথা আমলারা, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন রাজনীতিবিদরা।
আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির ব্যাখ্যায় শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। অনুন্নয়ন সরকারি ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ দেখা যাচ্ছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে বেতন এবং ভাতা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। ওই সময় অনেকে বিশ্বাস করেছিলেন যে, বেতন বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ছিল আমলাতন্ত্রকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এসব আমলা সরকারকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কারচুপিতে সহায়তা করেছিলেন।
আমলারা দুর্নীতির সুযোগ পেয়েছেন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে এমন দাবি করে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত, বড় মাপের সরকারি ঋণের কারণে ২০১৭-১৮ সাল থেকে ঋণের সুদ প্রদান বেড়েছে। এটি সরকারের বেতন ও ভাতার পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা জনবিক্ষোভের জন্ম দেয়। সরকারি খরচে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমলাদের দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে তথ্য অধিকার আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহারে বিধিনিষেধের কড়াকড়ি আরোপ করে তৎকালীন সরকার। এসব আইনে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে সাত হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এটি করা হয়েছে সরকারের স্বচ্ছতা সীমিত করতে।
এজন্য প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে দায়ী করে বলা হয়, এ পদক্ষেপগুলো নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে, জবাবদিহি হ্রাস করে এবং দুর্নীতিকে সক্ষম করে। দুর্নীতি দমন আইনের অধীনে সরকারি কর্মচারীদের বিচার করার আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা কর্মকর্তাদের জবাবদিহি থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
টিআইবির প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে শ্বেতপত্রে দেখানো হয়, ২০২১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি সমীক্ষা ক্রমবর্ধমান দুর্নীতিকে তুলে ধরে। ওই প্রতিবেদনে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার সরকারি পরিষেবাগুলোতে দুর্নীতির সম্মুখীন হয়। আইনপ্রয়োগকারী, পাসপোর্ট অফিস এবং সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। টিআইবির জরিপে উত্তরদাতাদের ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতির সম্মুখীন এবং ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মোকাবিলা করতে হয়েছে বলে জানান। এ দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে ২০১৭ সালে ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে দাঁড়ায় ৭০ দশমিক ৯ শতাংশে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক সংবাদ সম্মেলন করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এতে কমিটির প্রধান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বক্তব্য রাখেন। কমিটির অন্য সদস্যরাও সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেবপ্রিয় বলেন, “বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ থেকে ‘চোরতন্ত্রে’ পরিণত করা হয়েছে। আইনসভা, নির্বাহী বিভাগসহ সবাই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চুরির অংশ হয়ে গেছে। এটাই চোরতন্ত্র। এজন্য রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং উর্দি পরা কিংবা উর্দি ছাড়া আমলারা সহযোগী হলেন। এ চোরতন্ত্রের উৎস ২০১৮ সালের নির্বাচন।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও লোপাট করেছেন আমলারা। তারপর দুর্নীতির শীর্ষে রয়েছেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।’ এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তছরুপ হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের ১০ শতাংশ মানুষ ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে।’
গত সরকারের সময় ‘প্রতারণামূলক অনুশীলনের’ মাধ্যমে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তা ‘বিস্ময়কর’ বলে মতামত দেওয়া হয়েছে শ্বেতপত্রে। পদ্ধতিগত করফাঁকি, করছাড়ের অপব্যবহার এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত সরকারি অর্থায়ন রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছে, উন্নয়নকে স্থগিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে কমিটির সদস্য আবু ইউসূফ বলেন, ‘দেশের মাত্র ২০ থেকে ২২ লাখ টিআইএনধারী কর দিচ্ছে। বিরাট একটা অংশ এখনো করজালের বাইরে।’
বৃহৎ আকারের সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে গড়ে ৭০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। এসব প্রকল্পে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিলম্ব হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে, ১৪-২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১-২.৮০ লাখ কোটি টাকা) রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষের মাধ্যমে লুট করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের সময় তহবিলের অপব্যবহার এবং পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালকদের নিয়োগের ফলে সম্পদ আরও চাপা পড়ে যায়। ফলে অবকাঠামো এবং সামাজিক বিনিয়োগ থেকে সম্ভাব্য সুবিধাগুলো কমেছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়নে কিছু নির্বাচিত মেগা বা বড় প্রকল্প এবং অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করার মাধ্যমে অর্জিত যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তার বোঝা-পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে তাদের ঘাড়ে বহন করতে হতে পারে। দেশের যত ধরনের ক্ষতি করা যায়, তার সবকিছু করেই তারা (সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা) অর্থ বাইরে (পাচার) নিয়ে গেছেন।’
বিকৃত সরবরাহ ব্যবস্থা: চাল, ভোজ্য তেল এবং গমের মতো প্রধান পণ্যগুলোর জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পরিসংখ্যান ও চাহিদা বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। অনিয়মিত এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ক্রয় নীতিমালাগুলো শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে উপকৃত করেছে। ব্যবসাকেন্দ্রিক নীতিমালা ভোক্তাদের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের ওপর মজবুত ও নিয়মিত স্টক তদারকির অভাবে শুধু এ বিকৃতিগুলোকে আরও জটিল করেছে।
ব্যাংকিং এবং আর্থিক লুটের শীর্ষে: আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ২৪টি পদ্মা সেতু ও ১৪টি মেট্রোরেল করা যেত বলে জানিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে অর্থনীতির সব খাতের মধ্যে দেশের ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মন্দ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ আকাশ ছুঁয়েছে বলে জানিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি।
শ্রম অভিবাসন থেকেও লুট: গত এক দশকে ভিসা ক্রয়ের জন্য নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর হুন্ডি লেনদেনের মাধ্যমে ১৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, যা ঢাকা এমআরটি-৬ (উত্তরা-মতিঝিল) নির্মাণের খরচের চারগুণ। সিন্ডিকেট এবং শোষণমূলক নিয়োগের অনুশীলন অভিবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ন্যায়সংগত হয়নি। অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স কমে গেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘চরম ত্রুটিপূর্ণ তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা না হলে পুরনো খেলোয়াড়রা (যারা এসব খাত ধ্বংস করেছে) ফিরে আসতে পারে।’
বিদ্যুতে ৩০০ কোটি ডলার হাতবদল: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১০-১১ থেকে ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত বেসরকারি খাতে মোট ভাড়া পরিশোধের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। পুরো সিস্টেমের সামগ্রিক প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর গত পাঁচ বছরে ৪২ থেকে ৪৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে, যা একটি অত্যন্ত অদক্ষ সিস্টেমকেই তুলে ধরে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘রক্ষণাবেক্ষণ কমানো, তাৎক্ষণিক ক্ষমতা হ্রাস এবং জ্বালানির সম্পূর্ণ সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি ৬৫ শতাংশের ব্যবহৃত পূর্ণ ক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব। ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি এইচএসডি-ভিত্তিক আইপিপি প্ল্যান্টকে ২০১৮ সালে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি দেওয়া হয়েছিল, যার রেফারেন্স ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ছিল মাসে প্রায় ২০ ডলার/কিলোওয়াট।’
কিন্তু চুক্তির পুরো সময়কালে এসব কেন্দ্রের কোনোটিই গড়ে সক্ষমতার ১০ শতাংশের বেশি সচল হয়নি। যার ফলে কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই এক হাজার মেগাওয়াটের জন্য ৯০ শতাংশ ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে এটি নিয়ে কাজ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কাগজে-কলমে চুরির প্রমাণ নেই। বিদ্যুৎ খাতে বিগত সরকারের আমলে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ বা ৩০০ কোটি ডলার ‘হাতবদল’ হয়েছে।
আইএ
আপনার মতামত লিখুন :