লক্ষ্মীপুর: উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর প্রাচীণকাল থেকেই নারকেল-সুপারির জন্য বিখ্যাত। ‘নারকেল-সুপারিতে ভরপুর, আমাদের আবাস ভূমি প্রিয় লক্ষ্মীপুর’ এই প্রবাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও রয়েছে এই জেলার সুপারিকে কেন্দ্র করে। এখন সুপারির ভরা মৌসুম। বিভিন্ন হাটবাজারে পাকা সুপারির জমজমাট বেচাকেনা চলছে। বাজারগুলোতে ভিড় করছেন ব্যবসায়ীরা। এবার বন্যা পরিস্থিতিতির কারণে সুপারির ফলন হয়েছে কম, তবে দাম অন্যবারের তুলনায় বেশি হওয়ায় বাগানী ও বিক্রেতাদের মুখে ফুটেছে হাসি।অর্থকরী লাভজনক এ ফসল উৎপাদনে খরচ কম হওয়ায় সুপারি নিয়ে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পুরো জেলাজুড়ে। প্রতি বছর সুপারির আবাদ যেমনি বাড়ছে, তেমনি বাগানীদেরও উন্নত জাত নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে বেশ।
এ জেলার উৎপাদিত সুপারি বেশী সুস্বাদু হওয়ায় লক্ষ্মীপুরবাসীর চাহিদা মিটিয়ে এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও বিক্রি হচ্ছে। কৃষি বিভাগ বলছে, চলতি বছর সুপারির উৎপাদন ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বন্যা পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলতে সার প্রয়োগ, পরিচর্চা আর উন্নত চারা লাগানোর পরামর্শ তাদের।
সরেজমিনে জেলার সুপারি বাজারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে পাকা সুপারি কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সুপারি কিনে মজুত করছেন। তারা বেশির ভাগ সুপারি পানিতে ভিজিয়ে রাখছেন। কারণ মৌসুম শেষে পানসেবীদের কাছে ভেজা সুপারির কদর বেড়ে যায়। এসব উৎপাদিত সুপারির একটি বড় অংশ পান খাওয়ায় ব্যবহার হলেও, আর একটি অংশ দেশের বিভিন্ন ওষুধ ও কেমিক্যাল কারখানায় ব্যবহার করা হয়। বাজারে প্রতি পোণ (৮০টি সুপারিতে এক পোণ) সুপারি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরে বন্যায় ধান, সবজি ও অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ ভুগছিলেন চরম অর্থসংকটে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দারুণভাবে ভূমিকা রাখছে এই সুপারি। সুপারি বিক্রি করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন স্থানীয় চাষিরা। গত বছরের তুলনায় সুপারির দাম প্রতি পোণে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেশি পাওয়ায় হাসি ফুটেছে চাষিদের মুখে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছর সাত হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ৩৬ হাজার মেট্রিকটন সুপারি উৎপাদন হয়েছে। যার বাজার মূল্য বর্তমানে ৭০০ কোটি টাকারও বেশী।
জেলার সদর ও রায়পুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সুপারি চাষ হয়। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও পাশের জমিতে কমবেশি সুপারি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজার, রাখালিয়া, রসুলগঞ্জ, রায়পুর, হায়দেরগঞ্জ, চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারি, দত্তপাড়া ও দিঘলি বাজারে সবচেয়ে বেশি সুপারি কেনাবেচা হয়।
জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের প্রায় প্রতিটি এলাকায় সারিবদ্ধ সুপারি গাছে দৃষ্টি কাড়ে সবার। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি উৎপাদনে বেশ উপযোগী। উপকূলীয় এ জেলার ৫টি উপজেলার প্রতিটি বাড়ির আঙিনা ও পতিত জমিতেই সারিবদ্ধ রয়েছে সুপারি বাগান। বর্তমানে সুপারির শেষ সময়ে গাছ থেকে সুপারি সংগ্রহ, বিক্রি ও সংরক্ষণে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগানী, শ্রমিক, ক্রেতা-বিক্রেতারা। অর্থকরী এ ফসলকে ঘিরে এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে গত কয়েক বছর থেকে।
এদিকে সুপারি উৎপাদনে লাভবান হওয়ায় প্রতি বছরই এ অঞ্চলের মানুষ নতুন নতুন সুপারি বাগান তৈরিতে ঝুঁকছেন। চারা রোপনের ৫-৬ বছরে আসে ফলন। সামান্য পরিচর্চায় বছরের পর বছর ফলন পেতে শুরু করেন বাগানীরা।
স্থানীয়রা জানায়, অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত জেলার সুপারির হাটগুলো জমজমাট থাকে। চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বেপারিরা সুপারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন লক্ষ্মীপুরের হাটগুলো থেকে। জেলার সবচাইতে বড় বাজার হচ্ছে দালাল বাজার। এছাড়া রায়পুরের খাসের হাট, সদরের রুসুলগঞ্জ বাজার, জকসিন, কমলনগর ও রামগতিতেও বেশ জমজমাট সুপারি বাজার। চাষীরাও দরকষাকষি করে সুপারি বিক্রি করছেন এসব হাটে। কেউ বাজারে বিক্রি করে আবার কেউ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালান বলে জানান। এতে করে সুপারিতে আগ্রহ বাড়ছে এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের। সুপারির মৌসুমে কেউ সুপারি ভিজিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে পরে দাম বেশী হলে বিক্রি করেন। আবার কেউ পোণ হিসেবে অথবা কাহন (১৬ পণ) হিসেবে বিক্রি করেন। বর্তমানে প্রতি পণ সুপারী বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। যা গত বছর ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা।
এ বছর বন্যায় সুপারির আকার কিছুটা ছোট এবং ফলন কম হয়েছে বলে জানান বাগানীরা। তবে গেলো বছরের চেয়ে দাম বেশী পাওয়ায় স্থানীয়রা কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেন।
শ্রমিকরা জানান, সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছ থেকে সুপারি সংগ্রহ করা ও প্রক্রিয়াজাত সহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা। এতে তাদের প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা আয় হয়।
সদর উপজেলার রাখালিয়া বাজারের সুপারি ব্যবসায়ী তোফায়েল আহমেদ, মহিন উদ্দিন ও হোসেন মিয়া সোনালীনিউজকে বলেন, এবার সুপারির ফলন অন্য বছরের তুলনায় কম হলেও দাম বেশি পাওয়ায় বিক্রেতারা খুশি। এবার গত বছরের তুলনায় আমদেরও ব্যবসা ভালো হচ্ছে।
একই বাজারের সুপারি ব্যবসায়ী লুতু মিয়া সোনালীনিউজকে বলেন, তিনি চাষিদের কাছ থেকে সুপারি কিনেন। এ সুপারির কিছু পরিমাণ বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীদের কাছে ট্রাকে করে পাঠিয়ে থাকেন। আবার কিছু সুপারি পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। এবার বিভিন্ন জেলায় সুপারির চাহিদা বেশি এবং দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। এ জেলার সুপারি রংপুর, রাজশাহী, পঞ্চগড়, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লায় যাচ্ছে।
বেল্লাল হোসেন নামের আরেক সুপারি বিক্রেতা সোনালী নিউজকে বলেন, রাখালিয়া বাজারে ২৮ পোণ সুপারি এনেছি। সুপারিগুলো বিক্রি করছি প্রতি পোণ ১৫০ টাকা করে। এবার বাগানে সুপারি কম হলেও গত বছরের তুলনায় এ বছর ভালো দাম পেয়েছি।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দিন ফিরোজ সোনালীনিউজকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতির কারণে এবার সুপারি উৎপাদন কম হয়েছে, তবে দাম বেশি হওয়ায় চাষিরা খুশি। চলতি বছর ৩৬ হাজার মেট্রিক টন সুপারির উৎপাদন হয়েছে, যার বাজার মূল্য ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বন্যা পরিস্থিতি কাটিয়ে তুলতে বাগানীদের তাদের বাগানে সার প্রয়োগ, পরিচর্চা আর উন্নত চারা লাগানোর পরামর্শ দেন এ কর্মকর্তা।
এসএস
আপনার মতামত লিখুন :