কৃষকের হাসিতে হাসুক দেশ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২০, ০৩:২০ পিএম
কৃষকের হাসিতে হাসুক দেশ

ঢাকা : কৃষিই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ভরসার জায়গা। করোনাকালের ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যেও কৃষির সামগ্রিক উৎপাদন একথা আবারো প্রমাণ করেছে। একই সাথে আবারো প্রমাণ হলো, কৃষকরাই বাংলাদেশের নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক।  

কেননা করোনাকালে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ যখন লকডাউনে ঘরবন্দি তখনো মাঠে তৎপর ছিলেন বাংলার কৃষকরা। করোনার ঝুঁকি নিয়েও তারা দিনরাত খেটে ফলিয়েছেন সোনার ফসল।

বলতে দ্বিধা নেই কৃষকের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে ঘরবন্দি ১৭ কোটি মানুষের জীবন। করোনায় সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও কৃষকরাই সচল রাখেন দেশের অর্থনীতির চাকা।

বিভিন্ন বিশ্লেষণ বলছে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি বা সংগঠন করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরবন্দি মানুষকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে যা যা দিয়েছে তার অধিকাংশই ছিল কৃষিপণ্য।

অথচ করোনাকালে লকডাউনের সময় পরিবহন, হাট-বাজার সবকিছু বন্ধ থাকা আর ক্রেতারা গৃহবন্দি থাকায় কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। করোনার ক্ষতির মধ্যে এসেছে বন্যার দীর্ঘ স্থায়িত্ব। এর ফলেও কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও কৃষকরা দমে যাননি।
নিবিষ্ট মনে বাংলার কৃষকরা উৎপাদনে নেমেছেন ফসলের মঠে। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, করোনাকালে বাংলাদেশের কৃষি খাতের এই অবদান আবারো মনে করিয়ে দিয়ে  গেছে, ‘কৃষিই আমাদের আসল ভরসা।’

আমরা জানি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষি, তৈরি পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্সের ওপর। এদের মধ্যে তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স ওঠানামা করে। তবে কৃষি অনেকটাই স্থায়ী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

কারণ হিসেবে দেখা গেছে, নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর আবহাওয়ার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষি কোনো না কোনোভাবে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে।

করোনাকালের মহাবিপর্যয়ের মধ্যে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বাংলাদেশের জন্য একটি আশার বাণী শুনিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ধান উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের যে অংশগ্রহণ তার অর্ধেক এবং জাতীয় আয়ের ছয় ভাগের এক ভাগ আসে ধান থেকে। দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবার প্রতি বছর ১ কোটি ৫ লাখ হেক্টর একর জমিতে ধান চাষ করছে।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও মোট কৃষি উৎপাদন বাড়ছে। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ এবং পরিবেশসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসল।

কৃষির অন্যতম সাফল্য হলো, দেশে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ।

দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৯.১% এবং কৃষি খাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। আমাদের কৃষিকাজের ২১টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপের কাজ করেন নারীরা বা কিষানিরা।

দুঃখের বিষয় হলো, এই বিপুল সংখ্যক নারী কৃষকদের কাজের স্বীকৃতি নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফসলের প্রাক বপন-প্রক্রিয়া থেকে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণনের অনেক কাজ নারী কৃষকরা এককভাবে করে থাকেন।  দেখা গেছে, কৃষি খাতে ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ কাজই নারী কৃষকরা করেন বিনা মূল্যে।

প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়,  হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষুষ্ণ শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।

আমন, আউশ ও বোরো ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়।

সাড়ে ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে নবম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। বাংলাদেশ এখন চাল, আলু ও ভুট্টা রপ্তানি করছে।

কিন্তু এই কৃষকরা কেমন আছেন? কতটা ভালো আছেন? আমরা কি সে খবর রাখি। শহরে আমরা যারা বাস করি আমাদের প্রায় সবারই অস্তিত্বের শেকড় গ্রামের কৃষি পরিবার। আমরা সেই কৃষি পরিবারগুলোর প্রতি কতটা দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখছি? কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনতে গেলে আমরা দরদাম করি।

অথচ ফাস্টফুড আর চাইনিজে বসে বিনা বাক্যব্যয়ে অতিরিক্ত টাকা দিতেও আমাদের বিবেকে বাধে না। অথচ ফাস্টফুড আর চাইনিজে অথবা রেস্টুরেন্টে আমরা যা খাই তার সবই কৃষিপণ্য দিয়ে প্রস্তুত করা হয়।

আমরা জেনে-বুঝে অবলীলায় কৃষককে বঞ্চিত করি, অবহেলা করি। কৃষকের মর্যাদা বাড়ানো দরকার, কারণ কৃষকই উন্নয়নের প্রাণশক্তি।

বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। কৃষির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেক নজর রয়েছে। তারই ফল হিসেবে শহরের সব নাগরিক সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার রয়েছে বর্তমান সরকারের। তবে আমার মনে হয় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যাযামূল্য নিশ্চিত না করলে সেই সুবিধা কৃষকের উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতোই হবে।

কারণ তার আয় বাড়বে না, কিন্তু ব্যয় বাড়বে। এ বিষয়টি সরকারের বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে। বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কৃষক অল্প জমির মালিক কিংবা বর্গাচাষি হওয়ায় কৃষকের এ টাকার উৎস শুধু তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য বিক্রয়মূল্য; কিন্তু কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কৃষকের এ কষ্টার্জিত ফসলে লাভবান হচ্ছে দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতি মণ ধানের দাম থেকে প্রতি শ্রমিকের মজুরির দাম বেশি। বীজতলা থেকে শুরু করে প্রতি মণ ধান ঘরে তুলতে প্রায় হাজার টাকা খরচ হয়।

কিন্তু ধান বিক্রি হয় তার চেয়ে কম দামে। এতে করে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষকদের উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য দেওয়া উচিত। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে।

প্রত্যেক ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষক সমবায় বা গ্রাম পর্যায়ে কৃষক সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য বিক্রি ও উৎপাদন নিশ্চিত করা দরকার। আর মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের হাত থেকে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য আদায় নিশ্চিত করতে হবে। যে করেই হোক কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!