ঢাকা: গত বছরের মার্চে চীনের উহান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস।বিশ্বজুড়ে নেমে আসে স্থবিরতা।সারাবিশ্বের বিমান যোগাযোগ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। করোনার মহামারী নিয়ন্ত্রণে সাধারণ ছুটির সাথে সাথে দেশজুড়ে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে সরকার।থেমে যায় সব কিছু। তবে এমন অবচলাবস্থার মধ্যে অব্যহত ছিল দেশের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ।
এরমধ্যেও চলতি বছর ১২২টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে বর্তমান সরকার। নিজস্ব অর্থায়নে দেশ-বিদেশে আলোচিত পদ্মা সেতুর ৪১ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছে মূল সেতুর শতভাগ।
এছাড়াও মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, কয়লা ভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পায়রা বন্দর নির্মাণ এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
গত অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এসডিজির লক্ষ্য অর্জন, মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা ধরে রাখতে অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহসহ সার্বিক দিক বিবেচনা করে সরকার গত অর্থবছরের ২১ মে দুই লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য এসব অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়।
পরিকল্পনা কমিশন বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিনটি একনেক সভার আয়োজন করে। তাতে ২৪টি প্রকল্পে ৩৮ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারিতে ১৮টি প্রকল্পে ১৬ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়।
মার্চে চীন থেকে আসা করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তারপরও বাংলাদেশে সব কিছু স্বাভাবিক থাকায় দুটি একনেক সভায় বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর সংশোধিত প্রকল্পসহ ১৭টি প্রল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এই রেল সেতু হবে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন। সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ এই ভাইরাসে আক্রান্তের পর ১৮ মার্চ একজন মারা যান।
এরপরই ১৯ মার্চে এনইসিতে সংশোধন করে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়। একই সাথে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে ঘরে থাকতে বলে। করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকায় সাধারণ ছুটিও লম্বা হতে থাকে। চলে মে পর্যন্ত।
দুই মাসে কর্ম না থাকায় বেকারের সংখ্যা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে না থাকায় সরকার জীবিকা ও জীবনের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে গত জুন মাসে সীমিত পরিসরে সব কিছু খুলে দেয়। একই সাথে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ২১টি প্যাকেজের আওতায় এক লাখ ২১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী বাইরে না গেলেও কোনো কিছু থেমে থাকেনি। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়েই সব সময় সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ধরা হয়েছে ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার অর্থ ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।সব মিলে এডিপির আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
করোনার কারণে চলতি বছরে ব্যয় বাড়িয়ে স্বাস্থ্য খাতে ১৩ হাজার ৩৩ কোটি এবং কৃষিখাতে আট হাজার ৩৮২ কোটি টাকা করা হয়েছে।
আগস্ট থেকে আবার শুরু হয়েছে একনেক সভা। আগস্টে একটি একনেক সভায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে পাঁচটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘করোনায় উন্নয়ন থেমে থাকবে না।’ সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিক সময়ের মতোই চারটি একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ১৯টি প্রকল্পে ৯ হাজার ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়।
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে একটি প্রকল্পেরও অনুমোদন দেয়া হয়। জায়গাজমি নিয়ে খুনাখুনি হয়ে থাকে। মামলাও হয়ে থাকে। তাই ঝামেলা কমাতে ও মামলা এড়াতে ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্পেরও অনুমোদন দেয়া হয় গত সেপ্টেম্বরে।
করোনায় জনগণের পাশাপাশি অনেক সচিব, এমপি, মন্ত্রীর মতো পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও অক্টোবরে আক্রান্ত হন। তারপরও থেমে থাকেনি উন্নয়ন কাজের অনুমোদন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও বিকল্প পথে সাতটি প্রকল্পে ছয় হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়।
এসময়ে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে শহর-গ্রামের পার্থক্য কমাতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে ব্রিজ, কালভার্ট করে গ্রামেও ভারী পরিবহন চলাচলের সড়ক নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। সিটি কর্পোরেশনের সক্ষমতা বাড়াতে বলেছেন।
বিশ্বে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অনেক দেশ লকডাউন শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে পথে না গিয়ে মোকাবিলা করতে করোনার ভ্যাকসিনের বিকল্প হিসেবে দেশবাসীকে আগাম সতর্ক করে মাস্ক পরতে নির্দেশ দিয়েছেন। নভেম্বরে তিনটি একনেক সভায় ১৬টি প্রকল্পে ২০ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়।
এভাবে প্রতি মাসে সীমিত পরিসরে হলেও উন্নয়নকাজের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। ১ ডিসেম্বরও একনেক সভায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ব্রডব্যান্ডের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনসহ টেলিকমিউনিকেশন সংক্রান্তসহ চারটি প্রকল্পে দুই হাজার ১১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। ৮ ডিসেম্বর চারটি প্রকল্পে তিন হাজার ৯০৩ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এসআই/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :