ঢাকা : বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট হবে বিপুল দেশি ও বিদেশি ঋণনির্ভরতার বাজেট। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকারও বেশি।
এর মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ থেকে জোগান দেওয়া হবে, যা গত চলতি অর্থবছরের (২০২০-২০২১) তুলনায় ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
এ ছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ৭৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ কম। পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকে আরো ৩৭ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে, যা গতবারের চেয়ে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।
এদিকে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ইতিহাসে এবারের বাজেট হবে সর্বোচ্চ ঘাটতির বাজেট। ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা জিডিপির ৬.২-৬.৫ শতাংশের মধ্যে। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২০২১) বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশের সমান।
তবে সরকারের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘কৌশলগতভাবে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত ভালো উদ্যোগ দুটো কারণে।
প্রথমত, এটার সুদের পরিমাণ কম। সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হলে ১১-১২ শতাংশ সুদ দিতে হয়। কিন্তু বৈদেশিক যেসব উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ করা হবে সেখানে সুদের পরিমাণ সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই শতাংশ।
দ্বিতীয়ত, এসব ঋণের বেশিরভাগই দীর্ঘ মেয়াদের। ২৫-৩০ বছর মেয়াদের এসব ঋণ পরিশোধে তেমন বেগ পেতে হয় না। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের এখন ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও অনেক বেড়েছে।’
ড. আতিউর রহমানের মতে, সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে অর্থনীতির চাকা আরো সচল হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়বে। তখন আর ঋণ নিতে হবে না। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছুই নেই।
জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি করোনার মাঝে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীরা সরকারকে ঋণ দিতে প্রস্তুত রয়েছে। এসব ঋণ সহায়তা বাজেট ঘাটতি মেটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাজেটে ঘাটতির পক্ষে মত দিয়েছেন। বাজেট ঘাটতি ৭ থেকে ৮ শতাংশ করলেও কোনো অসুবিধা হবে না বলে মনে করেন তিনি। বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের বলে মত দেন তিনি। এমনিতেই প্রতি বছর ৫ শতাংশ ঘাটতি ধরে নিয়েই সরকার বাজেট প্রণয়ন করা হয়। সে হিসেবে এবারের বাজেটে কিছুটা বেশি ঘাটতিকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
কারণ অবকাঠামো উন্নয়নে যে ব্যয় হয় তা মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর হওয়ার বিকল্প নেই বলে মত দেন তারা। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে ঘাটতির হার সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) ছয় মাসে প্রায় ৬৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশি উৎস থেকে ৩০ শতাংশ এবং বাকি ৭০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খাত থেকে নেওয়া হয়েছে।
করোনা মহামারীর থাবায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি উদ্ধার, স্বাস্থ্য খাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব, কর্মহীন হয়ে পড়া এবং অসহায় ও দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর জোর দিচ্ছে সরকার।
এ ছাড়া এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান মহামারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট-বড়, মাঝারিসহ সব ধরনের উদ্যোক্তা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সহায়তা প্রদানে রয়েছে সরকারের আলাদা কর্মসূচি।
মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে সচল করতে বাজেট ঘোষণার আগেই দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা, গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা সরকারকে নানা পরামর্শ দেয়। এ কারণে প্রথমে সরকার নিজস্ব পথে হাঁটলেও পরে বাস্তবতা উপলব্ধি করে প্রবৃদ্ধির হার পুনর্নির্ধারণ করে। প্রথমে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করলেও পরে কয়েক দফায় কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের ঘরে নির্ধারণ করা হয়।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :