ঢাকা : বিশ্বব্যাপী করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প। সম্প্রতি রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। নতুন অর্ডারও তেমন মিলছে না। পাশাপাশি বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে পোশাক। এমন পরিস্থিতিতে বেশ কিছু মালিক পর্যাপ্ত কার্যাদেশ না পাওয়ার কারণে শ্রমিকদের বেতন দিতে না পেরে বাধ্য হয়েছেন কারখানা বন্ধ করে দিতে।
এদিকে, মহামারির কারণে বিশ্ববাজার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্নদিকে মোড় নেওয়ায় যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলায় এই শিল্পে আরো নতুন উদ্ভাবন, মানোন্নয়ন ও বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব চ্যালেঞ্জের মুখে নতুন করে এই খাত আরো সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববাজারে সুতাসহ পোশাক তৈরির বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন সংকট তৈরি হয়েছে।
এছাড়া, বর্ধিত দামে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দিতে অনীহা প্রকাশ করায় অনেকে বাধ্য হয়ে লোকসান দিয়েই বিক্রি করছেন পোশাক। কেউ ব্যবসা গুটিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছেন কারখানা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও কর্নফুলি ইপিজেডে পর্যাপ্ত কার্যাদেশ না পাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারায় ৮টি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা। চট্টগ্রাম ইপিজেডে বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে ৪ টির বিনিয়োগকারী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান, বাকি দুটি ডেনমার্কের।
এছাড়া, কর্ণফুলী ইপিজেডে বন্ধ দুটি কারখানার একটি ভারতের এবং অন্যটি যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। ইপিজেড নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বেপজা জানিয়েছে, করোনার প্রভাবে রপ্তানির অর্ডার কমে যাওয়া, ব্যবস্থাপনায় অভ্যন্তরীণ সমস্যা, শ্রমিকদের সময়মতো মজুরি পরিশোধ করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে এসব কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত আরো বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা জানিয়েছে, বাংলাদেশ ইপিজেড ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন (বেপজিয়া)।
অন্যদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারির দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ সুতার দাম বেড়ে যায়। আগে যেখানে প্রতি পাউন্ড তুলার গড় মূল্য ছিল ৭৫ সেন্টে, দাম বৃদ্ধি পেয়ে তা বেড়ে ৯০ সেন্টের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এছাড়া, অর্গানিক তুলার দাম ১ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু দেশের বাজারে সাধারণ সুতার দাম প্রতি কেজিতে ২৫-৩০ সেন্ট এবং অর্গানিক সুতার দাম বেড়েছে ৬০-৮০ সেন্ট পর্যন্ত। তাই সুতার দাম বাড়ায় প্রতি পিস টিশার্টের খরচ বেড়েছে গড়ে সাড়ে ছয় সেন্ট।
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, করোনার সময় ক্রয়াদেশে বাতিল ও স্থগিত হওয়ার অজুহাতে সুতার দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে যে হারে তুলার দাম বেড়েছে সেই হারে সুতার দাম বাড়েনি। একদিকে, বস্ত্রকলের মালিকদের কাছে সুতার মজুত না থাকার পাশাপাশি আর্থিক সংকটের কারণে অনেকে তুলা কিনতে পারছে না। অথচ চাহিদাও বেড়েছে। একারণেই দাম বেড়েছে।
গত মার্চ থেকে ভারত ও চীনের পোশাক কারখানাগুলো পুরোদমে চালু হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে পলিমার, ইয়ার্ন, ক্রাফট পেপার ও কেমিকেলসহ বিভিন্ন কাঁচামালের দাম ৪০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের দাম কমায় এক্সেসরিজ বিক্রেতারা পোশাক রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায় করতে পারছেন না। এতে লোকসানের মুখে পড়ছেন তারাও।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইয়ুথ লিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বায়লা) সাধারণ সম্পাদক আল শাহরিয়ার আহমেদ জানান, গত জানুয়ারি থেকে সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়তে শুরু করে। প্রতিকেজি সুতায় দেড় ডলার, পলিব্যাগ ও হ্যাঙ্গারসহ প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কাঁচামাল পলিমারের প্রতি টনে প্রায় সাড়ে ৬-শ ডলার বেড়েছে। এছাড়া, কার্টন ও বক্স তৈরির কাগজ প্রায় ৫২০ ডলার, প্রতিকেজি কালিতে ৩-৫ ডলার এবং কেমিকেলের দাম ৩০-৩৫ ডলার বেড়েছে। এদিকে, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য সোর্সিংয়ের পরিবর্তন নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং ফার্ম ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মহামারি সংকট দেশের পোশাক শিল্পকে অন্তিম মুহূর্তে এসে থামিয়ে দিয়েছে। সেইসঙ্গে বিশ্ববাজারে ফ্যাশনের উৎস খোঁজার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসায় তা পণ্য সরবরাহে বাংলাদেশের অবস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।’
ম্যাককিনসের রিপোর্টে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মূল্যায়ন করে বলা হয়, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী হিসেবে টিকে থাকার এবং নিজেদের অবস্থান আরো পাকাপোক্ত করার সব রকম সম্ভাবনা বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের রয়েছে। যদিও এই মুহূর্তে দেশের পোশাক খাতে নানা ঝড়ঝাপ্টা আসছে; তবে এই খাতের শীর্ষস্থান ধরে রাখতে হলে চূড়ান্ত পর্যায়ের কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হবে কর্তৃপক্ষকে।’
‘এক দশকের উন্নতির পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের আগামীর ভবিষ্যৎ কী?’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বাংলাদেশ কিভাবে এই ঝুঁকি মোকাবেলা করবে সেজন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকার যদি এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে, তাহলে দেশের জন্য তা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।’
এতে আরো বলা হয়, ‘পক্ষপাতদুষ্ট বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই হবে। আর এর জন্য গতানুগতিক ক্রেতা বাজারের কমে যাওয়া চাহিদা পূরণ করতে হবে এবং আরও চাহিদানির্ভর টেকসই সোর্সিং মডেল খোঁজার দিকে ঝুঁকতে হবে।’
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাশন পোর্টাল ‘জাস্ট-স্টাইল’ বিভিন্ন লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, ‘বাংলাদেশে পোশাক শিল্প খাতকে সফলভাবে এগিয়ে নিতে হলে এখন এই খাতে স্থিতিস্থাপকতা, টেকসই ধারণক্ষমতা, শ্রমিক উন্নয়ন ও অবকাঠামোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’
করোনার কারণেই মূলত এতসব সমস্যার উদ্ভব। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি সম্পন্ন দেশের পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :