ঢাকা: সরকার অভিভাবক হলেও সংকট সমাধানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না অভিযোগ করে তৈরী পোশাক খাতের শ্রমিক নেতারা বলেন, বিষয়টি যদি সরকার গভীরভাবে বিবেচনা না করে, মালিকরা যদি আমলে না নেয়, তাহলে পোশাক খাতে শ্রমিকরা আকস্মিক বিক্ষুব্ধ হয়ে যেতে পারে। শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য নতুন মজুরী বোর্ড দরকার। সিপিডি বলছে, করোনকালে গড়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ শ্রমিককে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়েছে। ৪২ শতাংশ কারখানা কোন নিয়মের মধ্যে নেই।
তবে এ দাবির জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, তারা শ্রমিকদের ভালো চান। তাদের যেমন অর্ধাহারে দেখতে চান না। আবার মালিকরাও ব্যয় সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ুক, তাও দেখতে চান না। এ ক্ষেত্রে একটি মধ্যপন্থা খুঁজে বের করতে হবে।
রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ‘সাম্প্রতিক আরএমজি প্রবৃদ্ধি: উপযুক্ত কর্মসংস্থান সম্পর্কে আমরা কী শিক্ষা পেয়েছি’ শীর্ষক সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বক্তব্য রাখেন, সিপিডি'র চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান (ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে), শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খালেদ মামুন চৌধুরী, তৈরী পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম, বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম, গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সভাপতি এডভোকেট মন্টু ঘোষ, বিআইডিজির সিনিয়র ফেলো মাহিন সুলতান, বিসিডব্লিউএসের নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার, ক্রিস্টান এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার নুজহাত জাবিন প্রমূখ।
অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষনা তুলে ধরে সংস্থার গবেষনা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ৪২ শতাংশ কারখানা কোন নিয়মের মধ্যে নেই। ৪৫ শতাংশ কারখানা ভাড়ায় চলে। ২৫ শতাংশ কারখানা সার্টিফিকেটে নেই। প্রায় ৩০ শতাংশ পোশাক কারখানাকে কলকারখানা পরিদর্শন বিভাগের পরিদর্শকদের বাড়তি অর্থ ঘুষ হিসাবে দিতে হয়েছে যা অবৈধ।
সিপিডি বলছে, করোনা কেটে যাওয়ার পর পোশাক খাতের শ্রমিকের কাজ করার হার ২০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু আশঙ্কাজনক হলো, দেশে যে নারী শ্রমিক একটা সময় ৮৫ শতাংশ ছিল, সেটি ধীরে ধীরে কমে ৬৮ শতাংশে নেমে এসেছে। কেন এই নারী শ্রমিকের আধিক্য পোশাক খাতে কমে এলো, তা নিয়ে গবেষণার দাবি রাখে। শ্রমিকের আয়ের তুলনায় ব্যয় সাড়ে ৯ শতাংশ বেড়েছে। ব্যয় সামলাতে তারা এখন আগের থেকে বেশি কাজ করছে। এতে ৮৪ শতাংশ কারখানায় অতিরিক্ত কাজের চাপের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পোশাক কারখানাগুলোতে গড়ে ৪০ জন করে শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে বলেও জানান গোলাম মোয়াজ্জেম।
গবেষনায় প্রকাশ পেয়েছে, নারী শ্রমিকের প্রতি যৌন হয়রানি কমলেও সাম্প্রতিক সময় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সাবকন্ট্রাক্টের কারখানায় বেড়েছে। অনেক কারখানায় শ্রমিকরা যথাযথ আইনি অধিকার পায় না। ব্র্যান্ড বায়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর লেবার রাইট ইস্যুতে মনিটরিং আগের তুলনায় কমেছে। এর বিপরীতে সা¤প্রতিক সময় পোশাক কারখানাগুলোতে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর অর্ডার বেড়েছে। দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ শ্রমিক করোনার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ নিছেন মাত্র ২০ শতাংশ শ্রমিক। বুস্টার ডোজ এখনো কেউ নেননি।
আগের তুলনায় পোশাক খাতের শ্রমিকরা ভালো আছে দাবি করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকদের আয়, পোশাক-আশাক, চলনেবলনে ও দক্ষতায় আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। এসব কারণে পোশাক খাতেও সমৃদ্ধি বেড়েছে।
তিনি বলেন, শ্রমিকের বর্তমান সংকট মালিক, শ্রমিক ও সরকার সম্মিলিতভাবে দূর করবে। আমাদেরকে একটি ব্যালেন্স ওয়ে আউট বের করতে হবে। সমস্যা থাকবে। এর জন্য আমাদের সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে।
পোশাক খাতে ট্রেড ইউনিয়ন আছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এর জন্য ইউনিয়নের নেতৃত্বকে শিক্ষিত হওয়া দরকার। তৈরী পোশাক খাতের অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আশানরুপ উন্নতি হয়নি। এজন্য আরও কাজ করার সুযোগ আছে। একে অপরের প্রতি দোষারপ না করে আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকেও এ সব ক্ষেত্রে আরও পরিস্থিতির উন্নতির তাগাদা রয়েছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, কারখানায় শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় দর-কষাকষির জন্য ট্রেড ইউনিয়ন থাকা দরকার। আমরাও সেটা চাই। তবে এ সকল ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের শিক্ষিত হতে হবে। তাদের শ্রমিক ও মালিকের স্বার্থ বুঝতে হবে। প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠানের প্রতি দরদ থাকতে হবে। জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। শ্রমিকদের স্বার্থ, সুযোগ, সুবিধা দেখার দায়িত্বও কারখানার মালিকের। উভয়ে মিলেমিশে কাজ করলে শোভন বা ডিসেন্ট কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্বব হবে এবং আমাদের তৈরী পোশাক শিল্প অনেক এগিয়ে যাবে।
শ্রমিক নেতারা জানান, এ পর্যন্ত যেসব শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের উদ্যোগ নিয়েছে তাদেরই চাকরি হারাতে হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটিতে বৈষম্যের অভিযোগ করে শ্রমিকরা জানান, সরকারি অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস। পোশাক শ্রমিকদের ৪ মাস এই বৈষম্য কমাতে হবে। এছাড়া কাগজে কলমে মাতৃত্বকালীন ছুটি কথা থাকলেও তা বেশিরভাগ শ্রমিক পান না। অনেক ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি নয়, চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।
নিত্যপণ্যের বেড়ে যাওয়া দামের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা এখন বেশি ওভারটাইম করছেন বলে একটি গবেষণায় উঠে এসেছে। এই অতিরিক্ত কায়িক শ্রমের ধকল সইতে না পেরে মৃত্যুও হয়েছে বলে দাবি করেছেন একজন শ্রমিক নেতা। এই পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ‘বেঁচে থাকার মতো ব্যয় নির্বাহে’ নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।
মন্টু ঘোষ বলেন, যে আয় আছে তা দিয়ে সে (শ্রমিক) চলতে পারছে না। বাবা-মা-ভাইবোনকে সে খাওয়াতে পারছে না। পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতেই বাড়তি পরিশ্রম করে তার জীবন ধ্বংস করছে। একজন শ্রমিক আট ঘণ্টার জায়গায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছে। হাড়ভাঙা অতিরিক্ত কাজের চাপ নিয়ে ইতিমধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছে। অথচ মালিকরা মনে করেন শ্রমিকরা ভালো আছে।
তার অভিযোগ, সরকার অভিভাবক হলেও সংকট সমাধানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। বিষয়টি যদি সরকার গভীরভাবে বিবেচনা না করে, মালিকরা যদি আমলে না নেয়, তাহলে পোশাক খাতে শ্রমিকরা আকস্মিক বিক্ষুব্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে পোশাকশ্রমিকদের রেশনিংয়ের আওতায় আনার পরামর্শও দেন এই শ্রমিক নেতা।
মো. হাতেম বলেন, আমরা আসলে সমস্যাগুলো আগে দেখি যাতে সমাধানটা বের করা যায়। সে কারণে সমস্যাগুলোই সবার সামনে আগে আসে। ট্রেড ইউনিয়নে শ্রমিকরা আগ্রহী নন বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয়া হচ্ছে না এই দাবিও সঠিক নয়।
বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, দেশে এখন ১১৩৬ ইউনিয়ন আছে। ফলে ইউনিয়ন করতে দেয়া হচ্ছে না- এই দাবি সঠিক নয়। নারী শ্রমিকের ঘাটতির পেছনে নারীর কাজে দক্ষতার ঘাটতিকেই দায়ী করেন তিনি।
সোনালীনিউজ/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :