ঢাকা : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট তথা বর্তমান মেয়াদে সরকারের পঞ্চম এবং আগামী নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালেরও পঞ্চম বাজেট। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের তিনটি মেয়াদের ১৫তম বাজেট এটি।
বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেল ৩টায় দেশের ৫২তম বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার ৫১টি বাজেট ঘোষণা করেছে। তবে ক্ষমতায় থেকে একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই টানা ১৫টি বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। দেশের ৫২তম বাজেট যা আগামী এক বছর দেশ পরিচালনার সার্বিক ব্যয়ের হিসাব রয়েছে এই বাজেটে।
এবারের বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’ ডিজিটাল বাংলাদেশের আরেক ধাপ ওপরে হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। বর্তমান নানা ধরনের সংকটের মধ্যেও স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১-এর স্বপ্ন দেখান অর্থমন্ত্রী।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখার লক্ষ্যে এবার বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেট। সরকারের আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে, যেখানে প্রায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। আগামী বছরে মোট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হবে জিডিপির ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ। আগামী ১ জুলাই থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট কার্যকর হবে।
আইএমএফের শর্ত পূরণ ও জনস্বার্থে কিংবা দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পণ্যে শুল্ক ও কর আরোপ কিংবা ছাড়ের প্রস্তাবনা আসতে পারে। এসব কারণে সার্বিকভাবে অনেক পণ্যের দাম বাড়বে।
দাম বাড়ছে যেসব পণ্যের: আইএমএফের শর্ত পূরণে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক আরোপ বা আগের চেয়ে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কারণে বলপয়েন্ট কলম, পলিপ্রপাইলিং ফিল্ম, এলপিজি সিলিন্ডার, মোবাইল ফোন, প্লাস্টিকের সব ধরনের গৃহস্থালি পণ্য (টিফিন বক্স ও পানির বোতল ছাড়া), টিস্যু পেপার, অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র, সানগ্লাস, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, প্রিন্টার, স্ক্যানার, রাউটার, ইয়ার ফোন, পেনড্রাইভ, এসএসডি কার্ড, সিসিটিভি মনিটর, প্রজেক্টর, ডিজিটাল ওয়াচ, ইলেকট্রিক প্যানেল, খেজুর, বাদাম, কাজুবাদাম, প্রসেসড ফ্রুটস, স্বর্ণের বার, বাসমতি চাল, সিমেন্ট, সিগারেট, বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ, গ্লাস, ই-সিগারেট, লিফট ও এসক্যালেটর, ফেসওয়াশ, টাইটেনিয়াম ডাই-অক্সাইড, আমদানিকৃত মোটরসাইকেল, স্যান্ডউইচ প্যানেলে দাম বাড়তে পারে।
দামি গাড়ি : ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট দামি গাড়ির ওপর নতুন করে আরোপ হয়েছে। ফলে ২০০১ সিসি থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি আমদানিতে এখন ২০০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসে। যেটা বাড়িয়ে ২৫০ শতাংশ এবং ৩০০১ থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ৩৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করে ৫০০ শতাংশ করা হতে পারে। ২০০০ সিসির বেশি ইঞ্জিন ক্ষমতাবিশিষ্ট গাড়ি সাধারণত জিপগাড়ি হয়। এখন দেশে বিপুলসংখ্যক জিপগাড়ি কিংবা এসইউভি মডেলের গাড়ি আসছে। জনপ্রিয় হচ্ছে জিপগাড়ির ব্যবহার। টয়োটা, মিতসুবিশি, নিশান, টাটাসহ নানা খ্যাতনামা কোম্পানির গাড়ির ব্যবহার বাড়বে।
নির্মাণ সামগ্রী : গত এক বছরে রড, সিমেন্ট, ইট ও অন্যান্য পণ্যের দাম ২০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে। এতে অনেক প্রকল্পের কাজ ৫০-৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে থেমে আছে। দেশে ক্রমাগত নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তে থাকার মধ্যেই সিমেন্টের কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ছে।
ভূমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সিডিএ) এলাকায় জমি নিবন্ধনের ট্যাক্স বিদ্যমান ৩ শতাংশ ও ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে যথাক্রমে ৪ শতাংশ ও ৫ শতাংশ হতে পারে। এছাড়া ফ্ল্যাট বিক্রিতে বিদ্যমান গেইন ট্যাক্স বাড়ছে। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে উভয় ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ গুণতে হবে।
সিগারেট : বাড়তি বাজেট বরাদ্দ করতে হবে ধূমপায়ীদের। কারণ বাজেটে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে। নিম্নস্তরের এক প্যাকেট (২০ শলাকার) সিগারেটের (যেমন-হলিউড, ডার্বি) দাম ৯০ টাকা, মধ্যম স্তরের (স্টার, নেভি) ১৩৪, উচ্চস্তরের (গোল্ডলিফ) ২২৬ এবং অতি উচ্চস্তরের (বেনসন, মালবোরো) সিগারেটের দাম ৩০০ টাকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে জর্দা-গুলের দামও। তবে বিড়ির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বাসমতি চাল : ধনীদের চাল হিসেবে খ্যাতি পাওয়া বাসমতি চাল আমদানিতে ভ্যাট বসানো হয়েছে। এতে চালের দাম বেড়েছে। এতে বিরিয়ানি কিংবা কাচ্চির দামও বাড়ছে।
কাজুবাদাম : সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজুবাদাম অনেকের কাছেই জনপ্রিয়। দেশে বাদাম চাষকে উৎসাহিত করতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করা হয়েছে। তাই আমদানি করা কাজুবাদামের দাম বাড়ছে।
আমদানি করা স্বর্ণবার বা স্বর্ণপিণ্ড : নতুন অর্থবছর আমদানি করা স্বর্ণের দাম বাড়ছে। কারণ, ব্যাগেজ বিধিমালার আওতায় বিদেশে থেকে আসার সময় ব্যাগে স্বর্ণ আনার পরিমাণ ২৩৪ গ্রাম (২০ ভরি) থেকে কমিয়ে ১১৭ গ্রাম করা হচ্ছে। আবার ভরিপ্রতি শুল্কের পরিমাণ ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
খেজুর : বাজেটে তাজা ও শুকনো খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে। ফলে পণ্যটির দাম বাড়ছে।
এলপিজি গ্যাস : তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) তৈরির কাঁচামালে শুল্ক বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ভ্যাটও। শুল্ক বিদ্যমান ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। আর ভ্যাট বিদ্যমান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
ভ্রমণ খরচ : ভ্রমণ কর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর হচ্ছে। বর্তমানে গন্তব্য বিবেচনায় ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হয়। এর ফলে উড়োজাহাজে ভ্রমণে ভোক্তার খরচ বাড়বে।
অ্যালুমিনিয়াম ও প্ল্যাস্টিকের গৃহস্থালি পণ্য : প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি টেবিল ও রান্নার পাত্র, টিস্যু পেপারসহ বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে।
আমদানি করা ফ্রিজ, ফ্যান, ও এস্কেলেটর : আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাজেটে এস্কেলেটর তৈরির কাঁচামালের শুল্ক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব থাকতে পারে। বর্তমানে এর হার ৬ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশ।
কোমল পানীয় : কোমল পানীয় খাতে বিদ্যমান টার্নওভার কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। যার কারণে বাড়বে।
ওভেন : আগামী জুলাই থেকে বিদেশি ওভেন আমদানি শুল্ক ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে মোট করভার করা হচ্ছে ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। ফলে বাড়বে ওভেনের দাম।
কলম : বাজেটে কলমের ওপরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসছে। সুতরাং দাম বাড়তে যাচ্ছে এই প্রয়োজনীয় পণ্যটিরও।
চশমা ও সানগ্লাস : চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে এবারের বাজেটে। পাশাপাশি উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে।
মোবাইল ফোন : স্থানীয় উৎপাদন ও সংযোজন পর্যায়ে মোবাইল ফোনের ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। তাই মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :