ঢাকা : দেশে ২০০৯-১০ অর্থবছরের পর সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরেই প্রথম আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা যায়, যা কিনা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঘাটতি। আর এ ঘাটতির কারণেই ক্রমাগত কমছে রিজার্ভ। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি।
অর্থনৈতিক এ সংকটের মধ্যেও গত বছর রেকর্ডসংখ্যক বিলাসবহুল গাড়ির নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে।
ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের যে কোনো ব্যস্ত রাজপথেই এখন হরহামেশাই চোখে পড়ছে- বিএমডব্লিউ, অডি, মার্সিডিজ বেঞ্জ, লেক্সাস, জাগুয়ার, পোর্শে ও রেঞ্জ রোভার মডেলের গাড়ি। পাশাপাশি দেশে সুপরিচিত টয়োটা কিংবা মিতসুবিশি ব্র্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি তো আছেই।
দেশের বাজারে গত বছরের একেবারে শেষ দিকে এসেছে জার্মান ব্র্যান্ড বিএমডব্লিউর নতুন মডেল ‘এক্স সেভেন’। এরই মধ্যে গাড়িটি ক্রেতাদের মাঝে ভালো সাড়া ফেলেছে বলে জানিয়েছেন এর পরিবেশক এক্সিকিউট মোটরস লিমিটেডের কর্মকর্তারা।
অটোমোবাইল খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্সিডিজ বেঞ্জ, অডি, ফোর্ড, ফেরারির মতো গাড়ির চাহিদা বাড়ছে। জাপানি প্রাডো, হ্যারিয়ার, টয়োটা করোলা ক্রসের মতো গাড়ির বাজারও অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বিআরটিএর গাড়ি নিবন্ধন তথ্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে।
এক জরিপেও দেখা গেছে, দেশে গত এক দশকে স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকল (এসইউভি) এবং অন্য বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহার বেড়েছে ৩৯ শতাংশের মতো। আবার বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিলাসবহুল হিসেবে পরিচিত গাড়িগুলোর অধিক সিসি পাওয়ার এবং ড্রাইভিং পারফরম্যান্স ও অন্যান্য ইউজার ফিচার সাধারণ সেডান গাড়ি থেকে অনেক বেশি। পাশাপাশি নিজেদের আর্থিক সাফল্যের স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবেও এসব গাড়ির মালিকানা থাকাকে বিবেচনা করেন এর ব্যবহারকারীরা। সাধারণত এসব এসইউভি বা বিলাসবহুল গাড়িতে যাত্রীর নিরাপত্তা, আরাম ও প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হয়। ফলে ব্যবহারকারীরা এসব গাড়িতে অনেক বেশি স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন।
১৮০০ সিসি বা তার চেয়ে বেশি ইঞ্জিন সক্ষমতার প্রাইভেটকার ও জিপকে ‘ঘ’ সিরিজে নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। ২০২২ সালে এ সিরিজের গাড়ি নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ২৩৬টি, যেখানে আগের বছর নিবন্ধন নেওয়া এ ধরনের গাড়ির সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৬০২। সেই হিসাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দেশে বিলাসবহুল গাড়ি নিবন্ধনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিলেও জাপান ও সিঙ্গাপুর থেকে ১ হাজার ২৫৬টি বিলাসবহুল গাড়ি এসেছে।
দেশের বিলাসবহুল গাড়ির বাজারটি এখনো জাপানি প্রযুক্তির দখলে থাকার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) মহাসচিব মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম। এইচএনএস অটোমোবাইলসের এ স্বত্বাধিকারী বলেন, ‘ইউরোপ বা আমেরিকান গাড়ি ক্রেতা এখনো বাংলাদেশের বাজারে তুলনামূলক কম। বিপরীতে জাপানি গাড়ির বাজার বেশ ভালো হচ্ছে। বিএমডব্লিউ, ফোর্ড বা মার্সিডিজ বেঞ্জের একটি গাড়ির দাম কয়েক কোটি টাকা।
অন্যদিকে ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মধ্যেই এসইউভি মানের জাপানি গাড়ি পাওয়া যায়। গাড়ির চাহিদার ক্ষেত্রে দামের বিষয়টি মুখ্য ভূমিকা পালন করে, যা জাপানি গাড়িগুলোকে সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছে।’
বিলাসবহুল গাড়ির ক্রেতা কারা- জানতে চাইলে শহীদুল বলেন, “আমি ‘বিলাসবহুল গাড়ি’ শব্দটির সঙ্গে একমত নই। এখন একটি ভালো ইঞ্জিন ক্ষমতা এবং উন্নত প্রযুক্তির গাড়ি ব্যবহারকারীদের কাছে প্রয়োজনীয়তার পর্যায়ে চলে এসেছে। ধরেন একজন ব্যবসায়ী, ওনার প্রজেক্ট আছে সাভারে বা গাজীপুরে। সেখানে যাতায়াতের জন্য তার একটি ভালো গাড়ি প্রয়োজন। তার ক্ষেত্রে কিন্তু গাড়ি বিলাসবহুল পর্যায়ে নেই। ভালো একটি গাড়ি তার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখা দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘গাড়ির নতুন ক্রেতার সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। অন্যদিকে আগে যারা স্টেশন ওয়াগন, এক্সিওর মতো তুলনামূলক কম দামের গাড়ি ব্যবহার করতেন, এখন তাদের মধ্যে একটু দামি গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। সার্বিকভাবে আমি বলব, গাড়ির ক্রেতা বাড়ছে। চাহিদাও আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর প্রধান কারণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। মানুষের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ দেশের মানুষ রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউর মতো গাড়ি চালাচ্ছে। বাংলাদেশ যে হারে অর্থনৈতিক উন্নতি করছে, তাতে ভবিষ্যতে গাড়ির চাহিদা আরও বাড়বে।’
দেশে এক দশক আগেও ‘ঘ’ সিরিজের জিপ বা বিলাসবহুল গাড়ির বার্ষিক বিক্রি ও নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল এক হাজারের আশপাশে। বিআরটিএর গাড়ি নিবন্ধন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে দেশে ‘ঘ’ সিরিজের গাড়ি নিবন্ধন পেয়েছিল ১ হাজার ৩০৩টি। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪৯টিতে। আর ২০১৫ ও ২০১৬ সালে বিলাসবহুল গাড়ি নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩ হাজার ৫৬৪ ও ৪ হাজার ৮৬৯টি। ‘ঘ’ সিরিজের গাড়ি নিবন্ধন পাঁচ হাজারের গণ্ডি ছাড়ায় ২০১৭ সালে। ওই বছর বিআরটিএ মোট ৫ হাজার ৪১৯টি ‘ঘ’ সিরিজের গাড়ি নিবন্ধন দেয়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫ হাজার ৫৪৭ ও ৫ হাজার ৬২৭-এ। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে অন্য সব গাড়ির মতো ‘ঘ’ সিরিজের গাড়ির নিবন্ধনও কিছুটা কমে যায়। ওই বছর বিআরটিএ থেকে ৪ হাজার ৯১১টি বিলাসবহুল গাড়ির নিবন্ধন নেন ব্যবহারকারীরা।
দেশে ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কার) অন্যতম বড় ক্রেতা সরকার। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে গত বছরের জুলাইয়ে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সংবিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ডলার সংকট তীব্র হতে শুরু করলে গাড়ি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতেও গড়িমসি শুরু করে ব্যাংকগুলো।
ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে গাড়ি আমদানির এলসি খোলা ‘প্রায় বন্ধ’। এতে আরোপ করা হয়েছে শতভাগ মার্জিন নীতি। সরকারের এমন নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের মধ্যেও দেশে ব্যক্তিগত গাড়ি বিক্রি বেড়েছে। শুধু বিলাসবহুল বা ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, সামগ্রিকভাবে দেশে গেল বছর সব ধরনের গাড়ির নিবন্ধন বৃদ্ধি পায় প্রায় ৩০ শতাংশ।
অটোমোবাইল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হকস বের স্বত্বাধিকারী ও বারভিডার সাবেক সভাপতি আব্দুল হক যদিও মনে করেন, গাড়ি নিবন্ধন ও বিক্রিতে আরও প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুপাতে গাড়ি ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখনো অনেক কম। যে হারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে গাড়ি নিবন্ধন ও বিক্রি আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। গাড়ি আমদানি ও বিক্রিতে সরকারি বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে না।’ তবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের গাড়ির বাজার কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে বলে জানান এ ব্যবসায়ী। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :