রিজার্ভে আইএমএফের শর্তের অব্যাহতি চাইবে বাংলাদেশ

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২৩, ০২:২৫ পিএম
রিজার্ভে আইএমএফের শর্তের অব্যাহতি চাইবে বাংলাদেশ

ঢাকা : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত মানার প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ জুন মাসের মধ্যে দুই হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রাখতে হবে। আর সেপ্টেম্বরে তা দুই হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে দুই হাজার ৬৮০ ডলারে রাখতে হবে। এই শর্ত মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার প্রেক্ষিতে গত জানুয়ারির শেষ দিকে আইএমএফ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ইতোমধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ছাড় করা হয়েছে। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার কথা আগামী নভেম্বরে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির আওতায় দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের আগে সংস্থাটির একটি রিভিউ মিশন বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

বুধবার (৪ অক্টোবর) থেকে তারা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসছে। এসব বৈঠকে ঋণ কর্মসূচির আওতায় যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন ও অগ্রগতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব মানদণ্ডে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এর মধ্যে রিজার্ভের দিক দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। ফলে এটিই শেষ পর্যন্ত আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী গত ২৭ সেপ্টেম্বরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ (আন্তর্জাতিক হিসাব পদ্ধতি-বিপিএম৬) অনুযায়ী ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে সেপ্টেম্বর শেষে রাখার কথা ছিল ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। তবে, প্রতি মাসেই রিজার্ভ থেকে সরকারি কেনাকাটার দায় মেটাতে সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। আর এ কারণেই প্রতি মাসেই গড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক বিলিয়ন করে কমে যাচ্ছে।

এদিকে, আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে সংস্থাটির একটি রিভিউ মিশন আজ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় আইএমএফের কর্মকর্তারা অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন।

একই দিন প্রতিনিধি দলটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে। মিশন চলাকালীন আইএমএফের কর্মকর্তারা বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। রিভিউ মিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইএমএফের পর্ষদ সভার অনুমোদন সাপেক্ষে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ আগামী নভেম্বরে ছাড় করা হতে পারে।

জানা যায়, সফরকালে আইএমএফ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির সূচকগুলো জানতে চাইবে। তবে মিশন এমন সময় সফর করছে, যখন রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও রিজার্ভে একধরনের বিরূপ প্রভাব চলছে। বেড়েছে খেলাপি ঋণের হারও। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪.৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত পাঁচ মাসে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বরে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। এসব বিষয় আইএমএফ আগে থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল।

এ মুহূর্তে আইএমএফ-এর হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলারে নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী এর অঙ্ক ২ হাজার ৭০৬ কোটি ডলার। তবে ঋণের জন্য শর্ত অনুযায়ী নিট রিজার্ভের লক্ষ্যে পৌঁছতে আরও ৩ দশমিক ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভ বাড়াতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখন আর বাড়ানো যাচ্ছে না।

তবে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার কমেছে। কারণ, জ্বালানি, সার ও খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য সরকারকে রিজার্ভে হাত দিতে হয়েছিল। বিষয়টি আইএমএফ-এর প্রধান কার্যালয়ে জানানো হয়েছে। আইএমএফ মিশন এসেছে। তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। নিট রিজার্ভ শর্ত পূরণ না হওয়ার কারণগুলো তুলে ধরে কনভিন্স করার চেষ্টা করা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত এই শর্ত থেকে অব্যাহতি চাওয়া হতে পারে।

প্রসঙ্গত, কোনো দেশ পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড (কিউপিসি) শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ার পরও আইএমএফ-এর নির্বাহী বোর্ড যদি মনে করে ঋণ কর্মসূচিটি চালিয়ে নেওয়া যাবে, তাহলে বাকি অর্থ ছাড়ের অনুমোদন আসতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সোমবার গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় অব্যাহতি চাইতে পারে সরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারের পলিসি এখনো পরিষ্কার নয়। তবে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে ঐকমত্য আসতে পারে।

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ৪৭০ কোটি ডলারের মধ্যে দুই ধরনের ঋণ রয়েছে। বর্ধিত ঋণ সহায়তা বা বর্ধিত তহবিল (ইসিএফ অ্যান্ড ইএফএফ) থেকে পাওয়া যাবে ৩৩০ কোটি ডলার। রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় পাওয়া যাবে ১৪০ কোটি ডলার। গত ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার বুঝে পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালীন বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের পর এক বিবৃতিতে আইএমএফ জানিয়েছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক ব্যয়ে সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, আর্থিক খাত শক্তিশালী করা, নীতি কাঠামো আধুনিক করে তোলা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কাজে এ ঋণ সাহায্য করবে।

এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় কমেছে ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসাবে জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। এ নিয়ে একধরনের সংশয়ের মধ্যে রয়েছে অর্থ বিভাগ। কেন রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে, এর ব্যাখ্যাও তুলে ধরা হবে মিশনের কাছে।

এছাড়া, বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে সরকারের যে নতুন ফর্মুলা কার্যকর করার কথা, সেটি হচ্ছে না। সমন্বয় করতে গেলে এ মুহূর্তে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য অনেক বেড়ে যাবে। তবে আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি নাগাদ এই ফর্মুলা কার্যকর করা হবে-এমনটি জানানো হবে আইএমএফকে।

আইএমএফ-এর শর্তের বেশকিছু প্রতিপালন করেছে সরকার। ইতোমধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পাশ করা হয়েছে। শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট গঠনের কাজ চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফ-এর হিসাব মতে নিট রিজার্ভ প্রকাশ করেছে। এছাড়া ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি কর্মপরিকল্পনা শেষ করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, যা এখনো হয়নি।

তবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে দেড় বিলিয়নের বেশি ডলার পাওয়ার প্রত্যাশা করছে সরকার। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল থেকে ৪০ কোটি ডলার, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছ থেকে ৪০ কোটি ডলার এবং বিশ্বব্যাংকের রেজিলিয়েন্স রিকভারি প্রোগ্রামের মাধ্যমে ২৫ কোটি ডলার আসার কথা। সব মিলিয়ে এ তিন উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে আসবে ১০৫ কোটি ডলার। এর সঙ্গে আগামী নভেম্বরে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির ৫১ কোটি ৯০ লাখ ডলার পাওয়ার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১৫৭ কোটি ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অর্থ এলে রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং নিট রিজার্ভের ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্ত পূরণের বিষয়টি সহজ হবে বলে মনে করছে সরকার।

এমটিআই

Link copied!