বিনিয়োগ সরছে ট্রেজারি বন্ডে, ব্যাংক আমানতে ‘ভাটা’

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৪, ১১:২৫ এএম
বিনিয়োগ সরছে ট্রেজারি বন্ডে, ব্যাংক আমানতে ‘ভাটা’

ঢাকা : আইনজীবী নাহিদা খানমের বেশ কিছু টাকা জমেছে। প্রথমে ভেবেছেন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন, পরে পরিচিত একজনের কাছ থেকে শুনলেন ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ এখন বেশি লাভজনক।

তার সঞ্চয়ী হিসাব ডাচ বাংলা ব্যাংকে। ব্যাংকটির ইস্কাটন শাখায় গিয়ে কথা বলে এসেছেন ট্রেজারি বন্ড কেনার বিষয়ে।

ব্যাংক খাতের আমানতকারীদের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের এই প্রবণতা খুব বেশি পুরনো নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই এতদিন এই বন্ডে বিনিয়োগ করতেন। আর ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগে মুনাফার কারণে এখন বিনিয়োগ বাড়িয়েই চলেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করা, রেমিটেন্স প্রবাহে লাফের মধ্যেও মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে আছে সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি যখন কমছে, তখন বাড়ছে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের প্রবণতা।

২০২৩ সালে বীমা কোম্পানি মেটলাইফ বাংলাদেশ তাদের বিনিয়োগের ১৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকা বা ৮৪ শতাংশই রেখেছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে।

এই অঙ্কটা আগের বছর ১৪ হাজার কোটি টাকার মত ছিল বলে জানিয়েছেন কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

২০২৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের মুনাফা ৪১ শতাংশ বৃদ্ধির পেছনেও অবদান রেখেছে বন্ডের বিনিয়োগ।

আরও কয়েকটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের কারণে রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা হয়েছে তাদের।

সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহার ১২ শতাংশ ও বন্ডে ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা যে কোনো আমানতের সুদহারের চেয়ে বেশি।

এই খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ চলে আসায় সরকারের সুদ পরিশোধের চাপ অনেকটা বেড়ে যাবে। এই চাপের কারণেই সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদহার কয়েক ধাপে কমিয়েছিল।

অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার ব্যাংক ঋণ করছে, কারণ সরকারের টাকা প্রয়োজন। অধিক ব্যাংক ঋণের কারণে বাড়ছে ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদের হার, যা সরকারের ব্যয় আরও বাড়াবে।

ব্যাংক আমানতে প্রবৃদ্ধির হারে ভাটা : ব্যাংকে আমানতের সিংহভাগই প্রাতিষ্ঠানিক। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার টাকাই এ আমানতকে স্ফীত করে। সেই সঙ্গে আছেন ব্যক্তি শ্রেণির অনেক বড় বিনিয়োগকারী।

তবে গত ছয় মাসের প্রবণতায় দেখা যাচ্ছে, আমানতের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবেই কমছে। অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করা, রেমিটেন্সে প্রবাহ গতি পাওয়ার মধ্যেও এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতির যে আকার, তাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ হওয়া উচিত ছিল। তবে বাস্তবে প্রবৃদ্ধি ওই অংক থেকে অনেকটাই কম।

এখন বহু ব্যাংকে আমানত রেখে সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি হারে সুদ বা মুনাফা পাওয়া যায়, তারপরও ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি ক্রমেই নিম্নমুখী।

গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। পরের মাসে তা কমে হয় ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে আরেকটু কমে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশে দাঁড়ায়।

এরপর মার্চে ৯.৯৯ ও এপ্রিলে নামে ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশে। মে মাসে কিছুটা বেড়ে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ হলেও তা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ০.০৪ শতাংশ পয়েন্ট কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখা যায়, চলতি বছর মে মাসে ব্যাংক খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৬০৮ কোটি টাকা, গত বছর যা ছিল ১৬ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ বেড়েছে ১৮ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা।

কী বলছেন ব্যাংকাররা : আমানতের প্রবৃদ্ধি এভাবে কমে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে সিটিজেনস ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাসুম বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এক ধরনের প্রভাব ফেলেছে। কারণ মাস শেষ হলে বাড়তি সঞ্চয়ের অর্থ আমানত হিসাবে ব্যাংক আসে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা মাস শেষে সঞ্চয় করতে সক্ষম হচ্ছেন না। ফলে আমানতে উচ্চ সুদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েও কাঙ্ক্ষিত আমানত পাওয়া যাচ্ছে না।

দুই বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এই পুরো সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। জুন মাসে তা ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে।

চলতি বছর মার্চ থেকে ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে ব্যাংকগুলো চাহিদা মত ঋণ ও আমানতে সুদ নির্ধারণ করছে।

ভালো ব্যাংকগুলো আমানতে ৮ থেকে ১০ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। তবে এসব ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো।

চাপে থাকা একাধিক ব্যাংক গ্রাহকদের ১২ শতাংশ হারে সুদ দেওয়ার প্রস্তাব করছে। কিন্তু সেসব ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখতে গিয়ে আস্থাহীনতায় ভুগছে, তার প্রমাণ, বেশি সুদ দিয়েও তারা আমানত টানতে পারছেন না সেভাবে।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক মনে করেন, আমানত কমার পেছনে মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ট্রেজারি বন্ডমুখী প্রবণতা।

তিনি বলেন, গত দুই বছরের তুলনায় সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের বদলে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ ঝুঁকছে। সামনে এ বিনিয়োগ আরও বাড়তে পারে।

২০২০ সালের জুন মাসে দুই থেকে ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ খাতে বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৪ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা।

৩৬৫ দিন কিংবা তার চেয়ে কম সময়ে ট্রেজারি বিলে ২০২০ সালের জুন মাসে বিনিয়োগ ছিল ৬৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের জুন শেষে এ খাতে বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা।

আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এই দুটি বড় কারণের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থাহীনতাও আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণ।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরো ব্যাংক খাতে আস্থা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাতে আমানত প্রবৃদ্ধি কমেছে।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আরফান আলী অবশ্য এক বা কয়েক মাসের প্রবণতা থেকে সিদ্ধান্তে আসতে চান না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছর মার্চ থেকে ঋণ ও আমানতের সুদ নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়। তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে আরও ছয় মাস সময় লাগবে। সেপ্টেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কেমন হয় তা পর্যালোচনা করতে হবে। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Link copied!