উন্নয়ন দর্শন নিয়ে দেশ এগোচ্ছে। যাতে অনেকটা সায়ও রয়েছে দেশের মানুষের। কিন্তু সেই উন্নয়ন যদি আমলাতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক হীনস্বার্থের কারণে বিলম্বিত হয়, তাতে খরচ বাড়ে প্রকল্পের। পকেট কাটা যায় সরকারের তথা জনগণের রাজস্ব ভাণ্ডারের। শুধু কী তাই, এই বিলম্বিত নির্মাণগতির কারণে বাড়ে জনভোগান্তি। আর বিলম্বিত নির্মাণগতির প্রকল্প যদি হয় রাজধানীসহ জনবহুল শহরে তা হলে তো ভোগান্তির শেষ থাকে না সাধারণের। কেননা এমনিতে যানজটসহ নিত্যকার নানা সমস্যায় আক্রান্ত রাজধানী। এর পরও ফ্লাইওভারের মতো অবকাঠামো নির্মাণে যদি গতিশীলতা না থাকে, তা হলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় ও বাস্তবায়নের সময় আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার। গত বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ব্যয় বৃদ্ধির দুটি প্রস্তাবে ২৭০ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। এ নিয়ে এই প্রকল্পটি তিন দফা ব্যয়বৃদ্ধি করা হলো। শুরুতে ২০১১ সালে প্রকল্পটির প্রাক্কলন ব্যয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। দরপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কাজের ধীরগতি এবং নকশায় ত্রুটির কারণে পর পর দুই দফায় একই সঙ্গে সময় ও খরচ বাড়ায় এ পর্যন্ত প্রকল্পের খরচ ৫৮ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকায় উঠেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময়সীমা বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কোথাও কোথাও প্রাথমিক কাজ শেষ হয়নি।
বাংলাদেশ নিুআয়ের একটি উন্নয়নশীল দেশ হলেও এখানে অবকাঠামো নির্মাণব্যয় পৃথিবীর যে কোনো উন্নত দেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু অনেক বেশি মূল্যে অবকাঠামো নির্মিত হলেও বাস্তবায়নের সময়কাল এবং কাজের মান দুই ক্ষেত্রেই পিছিয়ে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণব্যয় ২৫ গুণ বেড়েছে। প্রতি কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণে যেখানে ভারতে ব্যয় হয় গড়ে ১০ কোটি টাকা, চীনে ১০ কোটি, ইউরোপে ২৯ কোটি; সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৫৪ কোটি টাকা। সর্বশেষ ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ১২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। অবকাঠামো নির্মাণের এই ব্যয়ে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক-রাজতান্ত্রিক কমিশন বাণিজ্যকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। অবকাঠামো খাতের প্রায় প্রতিটি মেগাপ্রকল্পেই অস্বাভাবিক ব্যয়বৃদ্ধি ও সময়ক্ষেপণের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। যেখানে চীনা ও ভারতীয় কোম্পানিগুলো নিজ দেশে তুলনামূলক অনেক কম খরচে ও কম সময়ে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে যৌথভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা যথাসময়ে এবং প্রাক্কলিত ব্যয়সীমার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
আমরা দেখেছি ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চারলেন প্রকল্প, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার প্রকল্পসহ প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই অস্বাভাবিক হারে ব্যয়বৃদ্ধি ও সময়ক্ষেপণের প্রবণতা। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণব্যয় ৭০০ কোটি টাকা থেকে পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে আড়াই হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এ প্রকল্প নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর এসব দুর্নীতির দায়ভার বহন করতে হয় সাধারণ জনগণকে। নির্মাণচুক্তি লঙ্ঘন করে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোলের হার শুরু থেকেই দ্বিগুণ করা হলেও কর্তৃপক্ষের সেদিকে খেয়াল নেই। মেগাপ্রকল্পের নামে জনভোগান্তি এবং হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় বন্ধ করাই হবে সবার কাম্য।
সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :