প্রাথমিক শিক্ষক বদলি

বিভাগ বদলাতে লাখ, জেলায় ৫০ আর উপজেলায় লাগে ২০ হাজার টাকা

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪, ০২:২৩ পিএম
বিভাগ বদলাতে লাখ, জেলায় ৫০ আর উপজেলায় লাগে ২০ হাজার টাকা

ঢাকা : প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি যেন সোনার হরিণ। এক কর্মস্থলেই কেটে যাচ্ছে অনেকের জীবন। কাঙ্ক্ষিত কর্মস্থলে বদলি হতে না পেরে স্বামী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাচ্ছেন বহু নারীশিক্ষক। সফটওয়্যারের দোহাই দিয়ে বছরের পর বছর বন্ধ বদলি। কয়েক দফা চালু হলেও নানা শর্তে আর দালালদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিতে পেরে বদলিতে ব্যর্থ হাজারো শিক্ষক।

যদিও কোনো কোনো শিক্ষক আবার রাতারাতি ‘জনস্বার্থ’র আদেশে বদলি হয়ে মাঠ কার্যালয়ে হাজিরে অবাক হন শিক্ষা কর্মকর্তারা। ‘জনস্বার্থের’ নামে এই গোপন বদলিতে কর্মস্থলভেদে ১৫ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।

অবশ্য শুধু টাকাতেই নয়, কারও কারও আবার ‘মামার জোরে’ (প্রভাবশালী স্বজনের তদবির) মিলছে ‘জনস্বার্থে’ বদলির এই সোনার হরিণ।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বিত অনলাইন বদলি নীতিমালায় বলা আছে, জানুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে অনলাইনে নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে একই উপজেলা, আন্তঃউপজেলা, আন্তঃজেলা, আন্তঃবিভাগ বদলি করা যাবে। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘন বা শৃঙ্খলাজনিত কারণে বদলির পাশাপাশি অপরিহার্যতা বিবেচনায় সারা বছর জনস্বার্থে/প্রশাসনিক কারণে বদলি করা যাবে।

এ ছাড়া কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট দেখা দিলে পাশের বিদ্যালয় থেকে ডেপুটেশনের মাধ্যমে শিক্ষক দেওয়া হয়। বিভাগের বাইরে সচিব আর বিভাগের মধ্যে বদলির ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমোদন লাগবে। আর ‘জনস্বার্থে’ বদলির এই নীতিমালাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছে বদলি বাণিজ্যের বিশাল এক চক্র।

জানা গেছে, উপজেলার মধ্যে ‘জনস্বার্থে’ বদলি হতে চাইলে দিতে হয় ২০ হাজার টাকা আর জেলার মধ্যে ৫০ হাজার এবং বিভাগ বদলাতে লাখ টাকার মতো ঘুষ দিতে হয়। যার যত সমস্যা, তাকে ঘুষের টাকা গুনতে হয় তত বেশি। চাহিদা অনুযায়ী টাকা এবং গোপনীয়তার নিশ্চয়তা পেলেই আদেশ অনুমোদন হয়ে থাকে।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে বদলি নিয়ে ঘুষবাণিজ্যের আলাপনের স্কিনশর্ট দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে। সেখানে একজন শিক্ষক লিখেছেন, ‘৩ লাখ টাকা হলে মন্ত্রী দিয়ে বিভাগ বদলি করা যাবে, টাকা পরে দিলেও হবে।’ আস্থা অর্জন করতে সঙ্গে কয়েকটি বদলির আদেশের অনুলিপিও সংযুক্ত করা হয়।

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত মাত্র দেড় বছরে জনস্বার্থের নামে এমন আদেশে অন্তত ৪২৫ জন শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

জনস্বার্থের নামে বদলি-বাণিজ্যের বিষয়ে বরিশালের একজন শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘গত মার্চ মাসে আমাকে অধিদপ্তর থেকে ফোন করে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক না দেওয়ার জন্য বলা হয় এবং কয়েক দিন পর অধিদপ্তর থেকে একজন শিক্ষক জনস্বার্থে বদলির আদেশ নিয়ে আসেন। পরে শুনেছি ওই শিক্ষকের এজন্য ৯০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

বদলি বন্ধ থাকার পরও এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কিংবা এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় অনেক শিক্ষক যোগ দিতে আসেন। যদিও আমাদের মাধ্যমে করা হয়নি আবেদনগুলো। অনেকেই বলেছেন অতীতে হাতে হাতে আবেদন করা ছিল।’

জনস্বার্থের নামে বদলির এমন আদেশ হলেও প্রকৃতপক্ষে কার স্বার্থ দেখা হয়েছে, তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন খুলনা বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষা কর্মকর্তা।

‘জনস্বার্থে’র আদেশে বদলি হয়ে মৌলভীবাজারের বশিরপুর রেজি. বে. প্রা. বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অপরুপা ভট্টাচার্য্য সিলেট সদরের মুক্তিরচর স. প্রা. বিদ্যালয়ে গেছেন। রংপুরের পীরগাছা উপজেলা থেকে সহকারী শিক্ষক মোছা. জাকিয়া সুলতানা গেছেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার জগন্নাথপুর স. প্রা. বিদ্যালয়ে। আরেক শিক্ষককে খাগড়াছড়ি থেকে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। এর একটি বদলি আদেশেরও অনুলিপি দেওয়া হয়নি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ওয়েব পোর্টালে।

‘জনস্বার্থে’র আদেশে বদলির নামে ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আব্দুল হাকিমের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক আরও কয়েকবার কল করা হলে তিনি আর রিসিভ করেননি। পরে কল করার কারণ জানিয়ে কিছু প্রশ্ন করে আব্দুল হাকিমের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

পরে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়েরে সচিব ফরিদ আহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, অনলাইন নীতিমালা মেনেই সব শিক্ষকের বদলি হয়ে থাকে। অবশ্য নীতিমালাবহির্ভূত কোনো বদলি হয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সূত্র : দেশ রূপান্তর

এমটিআই

Link copied!