বর্তমানে পেশাজীবীদের সম্মান নির্ধারিত হয় পেশা দিয়ে নয় বরং সম্মান নির্ধারিত হয় বেতন গ্রেড দিয়ে।অথচ আমাদের দেশে কিছু মানুষ ও আমলারা প্রাথমিক শিক্ষকদের মিথ্যা শান্ত্বনা দিয়ে ঠকানোর জন্য একটা সুন্দর কথা ব্যবহার করে থাকেন,কথাটি হচ্ছে শিক্ষকতা একটি মহান পেশা, টাকা দিয়ে শিক্ষকদের মর্যাদা নির্ণয় করা যায়না।
গভীরে না গিয়ে শুধু উপরে উপরে বিবেচনা করলে এই কথাটি শুনে একেবারে মন ভরে যাবে।বিট্রিশরা যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের সারাজীবন গোলামীর শিকল দিয়ে বেধে রাখা ও কিছু কেরাণী সৃষ্টি করার জন্য লাট সাহেবের তিন ঠ্যাংওয়ালা কুকুরের এক ঠ্যাংয়ের পিছনে প্রতি মাসে যত খরচ করতো সেইরকম খরচ একজন শিক্ষককে প্রতি মাসে
বেতন হিসেবে দিত।
যদিও বিট্রিশদের নিজ দেশে অনেক আগে থেকেই শিক্ষকদের উচ্চ বেতন-মর্যাদা দিত।স্বাধীনতা লাভের পরে ভারত ও পাকিস্তান পারস্পরিক শত্রু হয়েও বিট্রিশদের সেই চক্রান্ত ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাদের দেশের শিক্ষা ও শিক্ষকদের পিছনে প্রচুর খরচ করে World Ranking এ ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশ এখনো সেই বিট্রিশদের চক্রান্ত থেকে ইচ্ছে করে বেড়িয়ে আসতে পারেননি।আমাদের দেশে শিক্ষকদের ছেলে ভোলানো গল্প শুনিয়ে যেভাবে ঠকানো হচ্ছে সেই বিষয়টা আজ তুলে ধরছি।
শিক্ষকদের মর্যাদা যদি টাকা দিয়ে নির্ণয় করা না যায় তাহলে উন্নত দেশের কথা বাদই দিলাম,আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত,পাকিস্তান,নেপাল ও শ্রীলংকা কেন শিক্ষকদের বেশী বেতন দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছেন?
আপনার কি ধারণা শিক্ষকদের উচ্চ বেতন দেয়ার কারণে ভারত,পাকিস্তান,নেপাল ও শ্রীলংকার শিক্ষকদের মর্যাদা আমাদের দেশের চেয়ে কম হয়ে গেছে?
এইসব কপটতা কেন শিক্ষকদের সাথে করা হচ্ছে? উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের কথাই বলি যাদের বেতন ১৩গ্রেড এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ২য় শ্রেণির স্নাতক পাশ।
একজন মেধাবী শিক্ষার্থী একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় প্রাথমিক শিক্ষকতায় কর্মরত থাকার পাশাপাশি ব্যাংকের আরেকটি ১০ম গ্রেডের পোস্টের সার্কুলারেও উত্তীর্ণ হলেন তাহলে এখন যারা বলেন শিক্ষকের মর্যাদা টাকা দিয়ে নির্ণয় করা যায় না, তারা বলুনতো ঐ মেধাবী শিক্ষার্থী এখন কি করবেন?
শিক্ষকতা পেশায় থাকবেন নাকি ব্যাংকে চলে যাবেন? এখানে উত্তর দিবেন যে ঐ মেধাবী শিক্ষার্থী ব্যাংকে চলে যাবেন।অথচ ভারতে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসেন।তাহলে আপনারা কীভাবে বলেন যে শিক্ষকের মর্যাদা টাকা দিয়ে নির্ণয় করা যায়না?
শুধু সালাম দেয়াই কি শিক্ষকের সম্মান,ভারত,পাকিস্তানের শিক্ষকরা সালাম পায়না বুঝি? তাহলে ভারত ও পাকিস্তানে কেন প্রাথমিক শিক্ষকদের উচ্চ বেতন মর্যাদা দেয়া হচ্ছে ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা অন্য পেশা ছেড়ে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসতেছেন?
আপনাদের মত বাকি দেশগুলোওতো বলতে পারতেন যে শিক্ষকের মর্যাদা টাকা দিয়ে নির্ণয় করা যায় না।কোন মেধাবী যখন আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসেন তখন তাদেরকে পদে পদে তাচ্ছিল্য করে বলা হয় আপনি মেধাবী হয়ে প্রাথমিকে কেন আসছেন,আপনাকে ব্যাংক,পুলিশ এই পেশাগুলোতে যাওয়া উচিত।
কেন ব্যাংকে অথবা পুলিশে যাওয়া উচিত কারণ ব্যাংকার ও পুলিশের পেশায় বেতনসহ অন্যান্য সকল সুযোগ-সুবিধা বেশী।তখন কোথায় তাকে আপনাদের ভন্ড ও দ্বিমুখী ঐ কথাটি যে শিক্ষকের মর্যাদা টাকা দিয়ে নির্ণয় করা যায়না।
উদাহরণ হিসেবে যদি বলি সমশিক্ষাগত যোগ্যতায় নিয়োগপ্রাপ্ত দুজন পেশাজীবী একজন প্রাথমিক শিক্ষক ও আরেকজন ব্যাংকার পাশাপাশি একই সমাজে বসবাস করেন। সমাজে চলার সময় একজন নিম্ন বেতনের শিক্ষকের পরিবারের সদস্যদের খাবার,পোষাক,শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ কি একজন ব্যাংকারের থেকে কম হয়?
শিক্ষকদের সমযোগ্যতার অন্য পেশাজীবীদের চেয়ে নিম্ন বেতন দিলে ঐ শিক্ষক কি হাওয়া দিয়ে উনার সংসারের খরচ নির্বাহ করবেন?
অনেকে হয়তো কোচিং-প্রাইভেটের কথা বলবেন।এই কোচিং প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষক আপনি প্রতি হাজার শিক্ষকের মধ্যে ৫জন পেতে পারেন।এই ৫জনের দায়ভার সকল শিক্ষকদের উপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছেন?
অনেকে আবার কথা ঘুরানোর জন্য বলবেন আগের শিক্ষকদের বেতনওতো কম ছিল,তারা কীভাবে জীবন চালাতেন? আগের সেই শিক্ষকরা কীভাবে কষ্টকর দিন কাটাতেন আপনি কি কোনদিন খোঁজ নিয়েছিলেন?
কত শিক্ষক সারাজীবন অন্যের সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের সন্তানদেরকে মানুষ করতে পারেন নি,কত শিক্ষক রোগে,শোকে,বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মারা গেছেন,কত শিক্ষক টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে অপমানিত হয়েছেন তার খবর কি রেখেছেন,নাকি কখনো তাদের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছেন?
নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুনতো আপনি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে কয়দিন আপনার প্রাথমিক শিক্ষকদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন?তাই শিক্ষকদের মর্যাদা নিয়ে এসব কপটতা আর করবেন না।
শিক্ষকদের নায্য মর্যাদা দিবেন না,ভালো কথা।বক্তৃতা,সেমিনার,বই-পুস্তকে শিক্ষকদের সস্তা মর্যাদার কথা বলা বন্ধ করুন কারণ আপনাদের এসব কপটতায় আপনারা লজ্জা না পেলেও শিক্ষকরা ঠিকই লজ্জা পান।
লেখক-মাহফিজুর রহমান, শিক্ষক ও ব্লগার
সোনালীনিউজ/এইচএন
আপনার মতামত লিখুন :