হুমকির মুখে শিক্ষার্থীদের জীবন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১৫, ২০২১, ১১:২১ পিএম
হুমকির মুখে শিক্ষার্থীদের জীবন

ঢাকা : মানুষের জীবন-জীবিকাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের প্রায় সব সেক্টরই খুলে দিয়েছে সরকার। ব্যতিক্রম কেবলই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। টানা প্রায় ১৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনা মহামারীতে একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো সেক্টরই এভাবে একনাগাড়ে বন্ধ থাকার দৃষ্টান্ত নেই।

অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সঙ্গে কেবল শিক্ষা কার্যক্রমই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানও। অসংখ্য শিক্ষক বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী হারিয়েছেন তাদের অর্থনৈতিক অবলম্বন প্রাইভেট টিউশনি।

পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায়।

এছাড়া, শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যাও দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। ফলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।

তারা চাইছেন, যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক। দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে মত শিক্ষাবিদ ও গবেষকদেরও।

সম্প্রতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক স্তরের কমপক্ষে ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি।

অন্যদিকে, অনলাইনে দূরবর্তী শিখন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে মাত্র ৩ শতাংশেরও কম শিক্ষার্থী।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মতে, করোনার যে পরিস্থিতি তাতে এই মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে যেসব এলাকায় সংক্রমণের হার কম সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে মত দেন।

তিনি বলেন, ‘শিক্ষাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার। এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। বর্তমানে স্থানীয় প্রশাসনকে করোনার সংক্রমণের ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটি একটি ভালো দিক। তো সে হিসেবে যেসব জেলায় সংক্রমণ কম সেসব জেলার প্রশাসনের উচিত যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা সাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা।’

ড. আরেফিন সিদ্দিকের মতে, বিভিন্ন বোর্ড সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন। তারা চাইলে প্রশ্নপত্রের একাধিক সেট করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করে পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারে।  

এদিকে, শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ছাড়াও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় প্রাথমিক স্তরে প্রায় ৩৪ লাখ এবং মাধ্যমিকের প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী ঝরেপড়ার শঙ্কায় রয়েছে।

পিপিআরসি এবং বিআইজিডির গবেষণা বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে।

যেসব শিশু সমাজের দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত, তাদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। অনেকদিন ধরে বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষায় ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদি নানান ঝুঁকিবৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে এখন আর করোনাকে নিয়ে ভীত হওয়ার পরিবর্তে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তিত অভিভাবকরা।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮৪% অভিভাবকই করোনা সংক্রমণ নিয়ে এখন আর আগের মতো চিন্তিত নন। আর বাকি ১৪% করোনা সংক্রমণ নিয়ে কম চিন্তিত।

রাজধানীর হলিক্রস স্কুলের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাওলী শামরিজার মা জাহিদা পারভেজ ছন্দা বলেন, ‘আমরা সন্তানদের নিয়ে প্রচণ্ড রকমের অশ্চিয়তার মধ্যে আছি। বাচ্চারা পড়াশোনার ধারে কাছে যাচ্ছে না।

সারাক্ষণ মোবাইলে গেমস খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর অনলাইনে ক্লাস শুরু হলে ঘুমিয়ে পড়ে। সারাক্ষণ বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে এখন সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চলে যায়।

সুতরাং শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখার যে উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে তা কেউই মানছে না। বরং আমরা চিন্তিত যে, বাচ্চারা লেখাপড়া থেকে যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, পরবর্তীকালে তারা শিক্ষায় মনোযোগী হবে কি-না তা নিয়েই সন্দিহান।’

শামীমা বেগম স্বপ্না নামের এক অভিভাবক জানান, তার ছেলে নারায়ণগঞ্জ সরকারি পলিটেকনিকে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী হওয়ায় যে সময়টায় তারা অফিসে থাকেন, সে সময় তাদের সন্তান বাসায় একা কী করে তা নিয়েই সারাক্ষণ চিন্তিত থাকতে হয়।

তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাসের পর মাস তো আর সন্তানকে বাসায় বন্দি করে রাখা যায় না। ফলে আমরা যখন অফিসে চলে যাই সে চলে যায় বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। আর বাসায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ভিডিও গেমস আর টিভি দেখেই সময় কাটিয়ে দেয়। লেখাপড়া একদম মন নেই তার।’ সন্তানকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শামীমা বেগমের দিন কাটে সন্তানের বখে যাওয়ার আতঙ্কে।

তিনি বলেন, ‘ইদানীং তার মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে পড়েছে। এছাড়া প্রায়ই মাথাব্যথায় ভোগে। ডাকলে সাড়া দেয় না। একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা দিন পার করছি।

আমি যদি এমন কোনো মাধ্যম পেতাম সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এই সমস্যা বলার, তাহলে তা-ই করতাম। তাকে দ্রুত স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার অনুরোধ করতাম।’

পিপিআরসি এবং বিআইজিডির গবেষণায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা নিয়ে অভিভাবকদের মতামত নেওয়া হয়। এতে দেখা গেছে, ৪৮% অভিভাবকই শিক্ষার ঘাটতি এবং ৫৯% অভিভাবক শিক্ষার প্রতি সন্তানদের অনুৎসাহ নিয়ে চিন্তিত। এছাড়া, ৩১% অভিভাবক অটোপাসে কর্মসংস্থান হওয়া নিয়ে চিন্তিত।

এদিকে অনলাইনে ক্লাসের কথা বলা হলেও নামিদামি কিছু স্কুল ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম তেমন সচল নেই। এ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েও সুফল মিলছে না।

শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা।

বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘স্কুলগামী শিশুদের একটা বড় অংশ শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে শিশুদের খাপ খাওয়াতে স্কুল পুনরায় খোলার সময় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার একটি মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সমস্যাগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি দ্রুত স্কুল কলেজ খুলে দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে পিপিআরসি’র চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোভিডের কারণে একটি অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করছি।

আমাদের পরামর্শ হচ্ছে শিক্ষার ঘাটতি ঠেকাতে, শিক্ষায় অনাগ্রহ কমাতে এবং অভিভাবকদের শিক্ষা সংক্রান্ত আশংকা দূর করতে পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার।’

এদিকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েকদফা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সরকার। গত ২৪ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছিলেন ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে।

তিনি তখন জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর এখন শুধু দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাস হবে। বাকিরা সপ্তাহে একদিন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্লাস করবে।

এরপর গত ২২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী জানান, ঈদুল ফিতরের পর ২৪ মে থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে  শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসমূহ আগামী ১৭ মে থেকে খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু সংক্রমণ না কমায় খুলে দেওয়ার বদলে বাড়ানো হয় ছুটির মেয়াদ।

সবশেষ গত ২৭ মে ১৩ জুন থেকে স্কুল-কলেজ খোলার নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এক আদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা এবং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলা হয়। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ইঙ্গিত দেওয়ার পরদিনই এই আদেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু সীমান্ত এলাকাগুলোতে আবারো পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর গত ১২ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে চলমান ছুটি ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!