ঢাকা : দেশে শিক্ষাখাতে ভয়াবহ দুর্নীতি চলছে বহু বছর ধরে। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত এ দুর্নীতির বিস্তার। মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির পিওন থেকে শুরু করে পদস্থ কর্মকর্তা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। অধীনস্ত দপ্তর ও সংস্থাগুলোর দুর্নীতিকে সমর্থন দেয়া, জিপিএ ফাইভ বিক্রি চক্র, চাহিদামতো পরীক্ষার কেন্দ্র, টেন্ডার, কেনাকাটা থেকে শৃুরু করে সর্বত্র একই অবস্থা।
সবমিলে শিক্ষায় অন্তত ১৪টি খাত চরম দুর্নীতিপ্রবণ খাত চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উল্লেখ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। দুদকের সুপারিশের ওপর ২৬ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভ্যন্তরীণ সভাও আয়োজন করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক এতে সভাপতিত্ব করেন। ওইসভা থেকে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভাগ ও এর অধীন সব দপ্তর ও সংস্থায় স্থাপিত অভিযোগ বক্সগুলো পুনরায় চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
দুদকের কমিশনার ড. মো: মোজাম্মেল হক খান বলেন, সম্প্রতি দুদকের একটি টিম শিক্ষা অধিদপ্তরে গেছে। শিক্ষাখাতের দুর্নীতি বন্ধে দুদকের প্রচেষ্টা, পদক্ষেপ সব সময় অব্যাহত থাকবে।
মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, দুদকের কিছু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ পাওয়া গেছে। পর্যবেক্ষণগুলোর সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। তিনি বলেন, এগুলো প্রতিটির ওপর আলোচনা শেষে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। পাশাপাশি কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। সুপারিশপত্রে দুদক কিছু ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আমরা এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা নেব এবং সহযোগিতা করব।
চিহ্নিত দুর্নীতিপ্রবণ খাত ও কাজের দিকগুলো হচ্ছে-বিভিন্ন ধরনের পূর্তকাজ নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি); নতুন পাঠ্যবই মুদ্রণ ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি; বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আরও আছে-প্রশ্নপত্র ফাঁস; নোটগাইড; কোচিং বাণিজ্য; শিক্ষক বদলি ও পদায়ন; প্রকল্প; প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার; অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ; প্রশিক্ষণের নামে অর্থ ব্যয়। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সংস্থাটি ৩৯টি সুপারিশ করেছে।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা নামে দুটি বিভাগ আছে। উল্লিখিত অভিযোগ শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বিষয়ে। অন্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ আর সুপারিশ রয়েছে।
দুদকের তালিকা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের কথা। এতে বলা হয়, শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেস, ট্রেজারি এবং পরীক্ষা কেন্দ্র প্রশ্ন ফাঁসের উৎস। এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও অপরাধী চক্র যুক্ত থাকতে পারে। প্রশ্ন ফাঁস রোধে ৮টি সুপারিশ করা হয়।
এরমধ্যে আছে-প্রশ্ন প্রণয়নে মেধাবী, সৎ ও মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষক বাছাই করে নিয়োগ কমিটিতে রাখা; তাদের নজরদারি করা; এ অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও আইসিটি আইনে মামলা করা। এছাড়া দুদকও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধে মামলা করতে পারবে। প্রশ্ন প্রণয়ন ও বিতরণে যারা থাকবেন তাদের সন্তান বা পোষ্য কেউ পরীক্ষার্থী নেই সেই অঙ্গীকার নেওয়া; পরীক্ষা কেন্দ্র সংখ্যা কমানো ও উপজেলা সদরে রাখার সুপারিশও করা হয়েছে।
এরপরই দুদক কোচিং ও নোট-গাইড ব্যবসাকে দুর্নীতির উৎস হিসাবে চিহ্নিত করেছে। শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পাঠদান না করা, পাঠ্যপুস্তক, কোচিং মালিক এবং কিছু শিক্ষকের অবৈধভাবে স্বল্পসময়ে সম্পদ অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষা কার্যক্রমের মনিটরিংয়ের অভাব এবং অভিভাবকদের অসচেতনতাকে এরজন্য দায়ী করা হয়। কোনো কোনো স্কুলের প্রধান অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অন্য বিষয়ের শিক্ষককে ইংরেজি-গণিতের ক্লাস দেন যাতে কোচিং বাণিজ্য করতে পারে।
এ ক্ষেত্রেও দুর্নীতি প্রতিরোধে ৮টি সুপারিশ করা হয়। যারমধ্যে আছে-শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিতে মনিটরিং জোর; সরকারি হাইস্কুলে নীতিমালা মেনে বদলি; গ্রামীণ স্কুলে গণিত ও ইংরেজির শিক্ষক সংকট দূর করা ও শহরের স্কুলে অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা যাতে এই দুই বিষয়ে ক্লাস নিতে না পারে তা নিশ্চিত করা।
এছাড়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বর্ণনামূলক, সৃজনশীল ও বিশ্লেষণধর্মী হওয়া উচিত। আর এমসিকিউ সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া; কোচিং নীতিমালার বাইরে যেসব শিক্ষক কোচিং করান তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া; কোচিং সেন্টার বন্ধ ও এর মালিকদের মধ্যে যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এ বিষয় খতিয়ে দেখবে দুদক। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই নোট-গাইড প্রকাশনা সংস্থায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে।
দুর্নীতির আরেক উৎস বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি হয়। এছাড়া জাল সনদে এমপিওভুক্তি, বোর্ড পরীক্ষার ফরমপূরণে কোচিং ফি আদায়, হোস্টেল-ভবন সংস্কার, শিক্ষাসামগ্রী কেনাকাটা, উন্নয়নসহ বিভিন্ন মনগড়া খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। নির্বাচনি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষায় সুযোগ দেওয়ার বিনিময়েও আদায় করা হয় অর্থ।
একইভাবে ভর্তির সময়ে নানা খাতে অর্থ আদায় এবং আদায়কৃত অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এসব দুর্নীতি রোধে পিএসসির আদলে কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ, মাউশি, ডিআইএসহ সরকারি দপ্তরগুলোতে নিয়মিতভাবে কর্মকর্তাদের বদলিসহ পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়।
দুদক বলছে, এনসিটিবিতে দুর্নীতির মূল জায়গা পাঠ্যবই ও কাগজ কেনার দরপত্র প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন কাজের কমিটি গঠনে। কর্মকর্তাদের কেউ কেউ স্বনামে ও বেনামে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন। এ ধরনের ব্যক্তি দরপত্রে অংশ নিলে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। নতুন পাঠ্যবই যখন প্রবর্তন করা হয় তখন এক শ্রেণির কর্মকর্তা বা কর্মচারী তা আগেভাগেই প্রকাশকদের কাছে সরবরাহ করেন যাতে তারা মূল বই শিক্ষার্থীর হাতে যাওয়ার আগে বাজারে গাইড ছেড়ে দিতে পারেন। এছাড়া পাঠ্যবই সংক্ষিপ্ত করায় কোচিং বাণিজ্য উৎসাহিত হয়েছে। এই অপকর্ম রোধে দুদক ৬টি সুপারিশ করেছে।
শিক্ষা খাতের পূর্ত কাজ করে থাকে ইইডি। এই সংস্থা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। মাত্র দুজন নির্বাহী প্রকৌশলী অধিকাংশ কাজের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। তাদের মধ্যে একজন প্রায় ৪০টি প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। সমালোচনা ওঠার পরে কিছু কমালেও এখনও অন্তত ৩০টি কাজের দায়িত্বে আছেন তিনি। এছাড়া প্রধান কার্যালয়ে বছরের পর বছর একই প্রকৌশলী কর্মরত আছেন। অথচ ৬৪ জেলায়ই এটির কার্যালয় আছে যেখানে বদলি করা যেতে পারে।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা নেয়। এর প্রশ্নপত্র কম্পোজ ও ছাপানো দায়িত্বে রাখা এমন খণ্ডকালীন কর্মরত কর্মচারীকে যিনি নিজে এবং তার স্ত্রী চাকরিপ্রার্থী ছিলেন। বিষয়টি জানার পর রহস্যজনক কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু একটি প্রতিবেদন চেয়ে দায় সারে।
মন্ত্রণালয়ে দুদকের পাঠানো সুপারিশপত্রে ইইডিতে দুর্নীতির উৎস হিসাবে চিহ্নিত দিকগুলো হচ্ছে-অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রাক্কলন, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি, যেমন-টেন্ডারের তথ্য ফাঁস, সমঝোতার নামে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সাপোর্টিং বা এজেন্ড ঠিকাদার নিয়োগ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, টেন্ডারের শর্তানুসারে কাজ বুঝে না নেওয়া, মেরামত বা সংস্কার কাজের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক বেনামে বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা করা। যেসব কর্মকর্তা নামে-বেনামে ঠিকাদারিতে জড়িত তাদের তালিকা তৈরি করে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও ফৌজদারি মামলাসহ ৭ দফা ব্যবস্থার সুপারিশ করে দুদক।
দুদকের উল্লিখিত সুপারিশ বিরোধী কাজ হয়েছে। সম্প্রতি ইইডিতে একটি নিয়োগ পরীক্ষা হয়। সেখানে প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের দপ্তরে কর্মরত অস্থায়ী কর্মচারীরা উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রশ্ন কম্পোজের কাজে জড়িত ছিলেন একজন নিয়োগ পরীক্ষার্থী। এই অভিযোগ ওঠার পরও পরীক্ষা বাতিল হয়নি। মন্ত্রণালয় শুধু এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ নিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে এবারে এসএসসি পরীক্ষার্থী গত বছরের চেয়ে ২ লাখের কম। কিন্তু কেন্দ্র বেড়েছে ১১১টি। প্রতিটা খাতে চলছে চরম দুর্নীতি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :