ঢাকা : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সে কারণে আবহাওয়ায় পরিবর্তন আসার সঙ্গে সঙ্গে রোগ-শোকেরও পরিবর্তন হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
শারীরিক নানা ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনে সব বয়সী মানুষের মধ্যে বাড়ছে নানা ধরনের মানসিক রোগ। শারীরিক রোগগুলো নজরে আসলেও মানুষের মধ্যে বছরের পর বছর গড়ে ওঠা মানসিক রোগগুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে। মানসিক রোগগুলো জটিল আকার ধারণ করলেই, পাগল আখ্যায়িত করে শেকলবন্দি করে রাখা হয়।
আবার শেকলবন্দি করা হলে সমাজের মূল স্রোত থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। পরিবারের বোঝা হয়ে পড়েন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারা অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছেন।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের কারণ জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তনের বেশি প্রভাব পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলে। বিশেষ করে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের লোকজনের মধ্যে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দেশের অন্য এলাকার মানুষের তুলনায় বেশি।
গত এক দশকে দক্ষিণের জেলাগুলোয় ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ঘাতক রোগে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এলেও, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনি রোগীর জটিলতাও বাড়ছে দিন দিন। এছাড়া জলবায়ুর কারণে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে নষ্ট হচ্ছে চোখের রেটিনা। ফলে বাড়ছে অন্ধত্বের পরিমাণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নিরাপদ পানির অভাব ও সচেতনতার অভাবে সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ বাধ্য হচ্ছেন কাছাকাছি উৎস থেকে প্রাপ্ত লবণাক্ত পানি পান করতে।
বাংলাদেশের নদীগুলোর উজানে ভারতীয় এলাকায় বাঁধ দেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে আসা মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেছে। নদীতে মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেলে সাগরের সঙ্গে যুক্ত নদীগুলোতে চলে আসে লবণাক্ত পানি। নদীতে লবণাক্ত পানি চলে এলে মাটির নিচের পানির স্তরে মিঠা পানির পরিবর্তে ঢুকে পড়ে লবণাক্ত পানি। এভাবে মিঠা পানি উৎস পরিণত হচ্ছে লবণাক্ত পানিতে।
আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে পানীয় জলের অন্যতম উৎস পুকুর ও বিলে লবণ পানিতে ভরে যায়। লবণযুক্ত পানি নলকূপ অথবা গভীর নলকূপের মাধ্যমে মানুষ পান করতে বাধ্য হচ্ছেন। শরীরে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াতে ছোট-বড় সবাই ভুগছে উচ্চ রক্তচাপে। দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- হার্ট, কিডনি, চোখের মতো প্রধান অঙ্গগুলো।
এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ অব্যাহত থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। শুধু দক্ষিণাঞ্চলেই নয়, সারাদেশেই উচ্চ রক্তচাপের রোগী বাড়ছে। শুধু যে পানীয় জলের সঙ্গে লবণ যাচ্ছে এমন নয়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত লবণও খেয়ে থাকেন।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তের সংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, রোগটি এ দেশের জন্য ‘নীরব ঘাতক’। দ্রুতগতিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও বেশিরভাগ মানুষই বিপদ সম্পর্কে অবহিত নয়। কিছু কিছু মানুষ খাবারে অতিরিক্ত লবণ খেতে না পারলে খাবার খেয়ে তৃপ্তি পায় না। জলবায়ু পরিবর্তনে পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে নিরাপদ পানি কিনতে গিয়ে অনেকে আয়ের প্রায় ১০ শতাংশ খরচ করে ফেলছেন।
অবশ্য ডায়াবেটিসের কারণেও রক্তনালিতে চর্বি জমে রক্ত চলাচলের পথ সরু হয়ে যায়। রক্ত স্বাভাবিক পথে চলাচল করতে না পারায় অভ্যন্তরীণ চাপ বেড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধমনি ফুলে ফেটে যাওয়া ও রোগীর অঙ্গহানিও হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হঠাৎ মৃত্যুর কারণও হয়ে থাকে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। যে তিনটি রোগ থেকে দূরে থাকতে পারলে কিডনি সুস্থ থাকে, সেগুলোর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ অন্যতম। দেশে দুই কোটির বেশি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগী রয়েছে।
উপরিউক্ত রোগগুলো ছাড়াও দেখা দিচ্ছে ডায়রিয়া, চর্মরোগ, চোখের ছানিপড়া, অন্ধত্ব তো আছেই। খুলনা বিভাগের কিছু সচেতন মানুষ লবণ ছাড়া পানি সংগ্রহ করতে দুই থেকে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। অন্যরা পানি সংগ্রহের এ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কাছের পানির উৎসের লবণাক্ত পানিই পানি করছেন। শুধু কি তাই মাটির নিচে লবণ পৌঁছে যাওয়ার কারণে ডাব পর্যন্ত লবণাক্ত হয়ে গেছে। ওইসব এলাকার ফসলের মধ্যে লবণ ঢুকে পড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলীয় বাসিন্দারা। খুলনার পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের নদ-নদীতে লবণের মাত্রা ৩ থেকে ৫ পিপিটি (পার্টস পার ট্রিলিয়ন) পর্যন্ত বেড়েছে। এই বৃদ্ধিটা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা আরও বাড়বে। এতে অনেক মানুষের স্বাস্থ্যসহ জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে।
যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্র্যাফট এক জরিপে বলেছে, পৃথিবীর ১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে।
বাড়ছে সংক্রামক ও মানসিক রোগ : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বেড়েছে তাপমাত্রা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে সংক্রামক ও মানসিক রোগ। যে ম্যালেরিয়া বাংলাদেশ থেকে দূর হওয়ার পথে, সেই ম্যালেরিয়া জীবাণুযুক্ত অ্যানোফিলিস স্ত্রী মশাও ফিরে আসবে খুব শিগগিরই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহমানকাল ধরে চলা বাংলাদেশের ঋতুতেও এসেছে পরিবর্তন। গ্রীষ্মকাল আগের তুলনায় দীর্ঘ ও গরম হচ্ছে এবং শীতকালে তেমন শীত পড়ছে না, তুলনামূলক উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে। ১৯০০ সালের প্রথম থেকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে। আগের তুলনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে ফেব্রুয়ারি, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক একটি গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। এই গবেষণাটি করা হয় ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বায়ুর ব্যাপ্তি জুন থেকে অক্টোবরের পরিবর্তে এখন ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিরাজমান। গড় বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে জুন থেকে আগস্ট মাসের পরিবর্তে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বেড়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে ১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস; এরপরই নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে যথাক্রমে ১.৮ থেকে ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের মধ্যে সংক্রামক রোগগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার অস্তিত্ব বাংলাদেশে সারা বছরই পাওয়া যাচ্ছে। ১৯০১ থেকে ২০১৯ সময়ের মধ্যে গত ১২০ বছরে সবেচেয়ে বৃষ্টিপাত বেশি বেড়েছে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে যথাক্রমে ৪৩.৮ মিলিমিটার ও ৪২.২ মিলিমিটার। অন্য দিকে মৌসুমি বায়ুর ভরা সময় জুনে গড় বৃষ্টিপাত কমেছে মাইনাস ৬৩.২ মিলিমিটার। আগস্টেও কমেছে মাইনাস ৪৯.৯ মিলিমিটার।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ২০১৯ সালে ঢাকায় গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভারী বর্ষণ হয়েছে প্রতিকূল তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সময় ৫১ শতাংশ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এবং জীবাণুবাহী এই জ্বরে ৭৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবে ২০১৯ ও ২০২০ সালে সমীক্ষায় বাংলাদেশের মানুষের ৬ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার জন্ম হয়েছে এবং ১৬ শতাংশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিষণ্ণতা। এ ধরনের মানসিক রোগে যারা ভুগছেন তাদের বেশির ভাগই বয়স্ক, দরিদ্র ও নানা ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ।
গ্রামীণ মানুষের চেয়ে শহুরে মানুষের মধ্যে মানসিক রোগের সংখ্যা বেশি। বিষণ্ণতা সবচেয়ে বেশি ৬৫ ঊর্ধ্ব বয়সী মানুষের মধ্যে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩৪ শতাংশ মানুষের মধ্যে জীবাণুবাহী রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যেখানে এর জাতীয় গড় ২৫ শতাংশ। শুষ্ক মৌসুমের চেয়ে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের সময় জীবাণুবাহী রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
২০০০ সালের আগে বাংলাদেশের মানুষ ডেঙ্গুজ্বর নামে কোনো রোগের নামই শুনেনি। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে অনুকূল পরিবেশে বাইরে থেকে ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা চলে আসে বাংলাদেশে এবং এ মশাগুলো বাংলাদেশে বংশবৃদ্ধি করে নিজেদের মানিয়ে নেয়। ফলে ২০১৯ ও ২০০০ সালে ডেঙ্গুর মহামারি দেখা দেয়। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :