সরকারি চাকুরেদের মহার্ঘ ভাতায় অতিরিক্ত ব্যয় সাত হাজার কোটি টাকা

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৫, ১০:৪৯ এএম
সরকারি চাকুরেদের মহার্ঘ ভাতায় অতিরিক্ত ব্যয় সাত হাজার কোটি টাকা

ঢাকা: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেড অনুযায়ী দুই ভাগে ভাগ করে মহার্ঘ ভাতা দিতে পারে সরকার। সাড়ে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীকে মূল বেতনের সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর জন্য এক বছরে সরকারের বাড়তি খরচ হবে অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই বাড়তি ব্যয় যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর আওতাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘মহার্ঘ ভাতা’ সংস্থানের বিষয় পর্যালোচনা করতে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে একটি বৈঠক করেছে। কমিটির আহ্বায়ক প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ভিত্তিতে মহার্ঘ ভাতা দিতে ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ।

এ ক্ষেত্রে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে এক অর্থবছরে বাড়তি প্রয়োজন হবে প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

তবে অর্থ ব্যয় কিছুটা কমাতে ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও প্রথম থেকে দশম গ্রেডের কর্মচারীদের ১০ বা ১৫ শতাংশ হারে ভাতা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম থেকে দশম গ্রেডে ১০ শতাংশ দেওয়া হলে প্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হবে। আর ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে আরও একটু বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৭ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রথম থেকে দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা ২০ শতাংশ এবং ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা ৩০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতার দাবি জানিয়েছেন। তবে পর্যালোচনা কমিটির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলো, মহার্ঘ ভাতা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ দেওয়া যেতে পারে। সাধারণত মূল বেতনের ওপর মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়। শুধু মূল বেতনের ওপর দেওয়া হবে নাকি মূল বেতনের সঙ্গে যোগ করে এর ভিত্তিতে অন্যান্য ভাতাও বাড়ানো হবে, তা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। মহার্ঘ ভাতার ভিত্তিতে অন্যান্য ভাতা বাড়লে এ খাতে অর্থ আরও প্রয়োজন হবে। শিগগির কমিটির আরও একটি বৈঠক হবে। সেখানেই বিষয়গুলো চূড়ান্ত হবে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে তথ্য অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। কোন সময় থেকে মহার্ঘ ভাতা চালু হবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তাই এ অর্থবছরে এ বাবদ কত টাকা বাড়তি প্রয়োজন হবে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ইতোমধ্যে গত সরকারের আমলে ‘বৈষম্যের শিকার দাবি’ করা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েক দফায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া প্রশাসনের ‘পদবঞ্চিত’ ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৫ কোটি টাকা দেওয়া সিদ্ধান্তও হয়। সব মিলিয়ে চলতি বাজেটে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় বেশ বাড়বে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। 

সূত্র আরও জানায়, মহার্ঘ ভাতার বাড়তি ব্যয়ের হিসাব করা হয়েছে চলতি বাজেটে বরাদ্দের ভিত্তিতে। তবে প্রতিবছর বাজেটে বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ ৬ থেকে ৮ শতাংশ বাড়ে। সেই হিসাবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দাঁড়াতে পারে প্রায় সাড়ে ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা বাবদ যোগ হবে আরও প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, নতুন অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হবে প্রায় লাখ কোটি টাকা। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কয়েক বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে গত জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনকে ঘিরে অস্থিতিশীলতায় সরকারের রাজস্ব আহরণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে। তাই সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই হোটেল-রেস্তোরাঁ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ওষুধ, কোমল পানীয়সহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনশীল মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করার কথা বলা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এখনই মহার্ঘ ভাতা দেওয়াটা যৌক্তিক সময় নয়।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ এমন তো নয়, সরকারি কর্মচারীরা খুব কম বেতনে চাকরি করছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বেসরকারি খাতের চেয়ে বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। উপসচিব হলেই বিনা সুদে গাড়ির ঋণ এবং সেই গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে বাড়তি ৫০ হাজার করে টাকাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। তার পরও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক, তা বলা মুশকিল।

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো ব্যাখ্যা থাকতে পারে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রশাসনে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে তাদের কার্যক্রমে ১০০-এর মধ্যে ৫০ দেওয়ার মতো পরিবেশও নেই। তাই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার মনে করছে, মহার্ঘ ভাতা দিলে প্রশাসন সরকারকে পরিপূর্ণ সহায়তা করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মহার্ঘ ভাতা দিলেই কি তারা সহায়তা করবে? তবে ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য এ ধরনের কিছু উদোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সবার জন্য বাস্তবায়নের ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্ক করে দেন তিনি।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন ব্যয় সংকোচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন প্রয়োজন। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে তখন মহার্ঘ ভাতার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। 

মহার্ঘ ভাতা পর্যালোচনা কমিটির সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, আগামী বাজেটের আগেই মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হবে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সময় মহার্ঘ ভাতা মূল বেতনের সঙ্গে যোগ হবে। এবার পেনশনভোগীরাও এ ভাতা পাবেন।
 
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর একটি নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করার কথা। সর্বশেষ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে অষ্টম স্কেল কার্যকর হয়। সেই সময় নতুন স্কেলের সুপারিশ না করলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে বার্ষিক বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল বেতন কমিশনের। কিন্তু ২০২৩ সালের জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পান। এদিকে বাড়তি মূল্যস্ফীতিতে বেতন বাড়াতে নতুন পে-স্কেল ঘোষণাসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আসছিলেন সরকারি চাকরিজীবীরা। 

এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে পরবর্তী সময় তা কার্যকর না হলেও বিশেষ সুবিধা হিসেবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া হয়, অর্থাৎ গত বছরের জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ১০ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) পাচ্ছেন।

এম

Link copied!