ঢাকা : সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক ইস্যু ইউক্রেন সংকট বাংলাদেশকেও বেকায়দায় ফেলেছে। ইউক্রেন পরিস্থিতিতে ঢাকাকে পক্ষে রাখতে রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্ব জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়া, ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা পৃথকভাবে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এ ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর জোর লবিং চালাচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্নিষ্ট একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ইউক্রেন পরিস্থিতি বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সামনেও বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। কারণ, এ সংকট পুরো বিশ্বকে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্রমশ বিভক্ত করে ফেলছে। অবশ্য পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে কারও পক্ষেই অবস্থান নেবে না বাংলাদেশ।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ইউক্রেন পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের চেয়ে বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে এসেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা এ সংকট ঘিরে রাশিয়ার মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। পরিস্থিতি এমন দিকে যাচ্ছে যে, বিশ্ব আবারও সত্তর দশকের মত দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ সংকট বিশ্বকে সামনের দিনগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরেই বিভক্ত রাখবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কারও পক্ষ না নিয়ে কূটনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা কঠিন হবে। কারও পক্ষ না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক রক্ষা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে।
যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বড় বাজার পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র। আবার অবকাঠামো উন্নয়ন সহযোগিতায় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড়। রাশিয়ার সঙ্গেও মেগা প্রকল্প রয়েছে। আবার জনশক্তি বাজারের বিবেচনায় ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেন পরিস্থিতি আরও সংঘাতমুখর কিংবা জটিল হলে এসব দেশের সঙ্গে সমান সম্পর্ক রক্ষা করা জটিল হয়ে পড়বে।
এ ছাড়া সম্ভাব্য সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার পরিবর্তে আরব বিশ্ব থেকে অতিরিক্ত তেল-গ্যাস আমদানি শুরু করলে জ্বালানির বাজারেও বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এ ধরনের চাপ সামাল দেওয়া বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য কঠিন হবে। আবার বাংলাদেশের শ্রম বাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরব দেশগুলো ইউক্রেন পরিস্থিতিতে সরাসরি কোনো পক্ষে অবস্থান নিলে বেকায়দায় পড়তে পারে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকটও বাংলাদেশের জন্য ক্রমাগত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকট ঘিরেও ভূরাজনীতির খেলা রয়েছে। ফলে কূটনৈতিকভাবে বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানও বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।
কোন পথে যাবে বাংলাদেশ: সাবেক একজন কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিদ্যমান বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বাস্তব অবস্থার সঠিক বিচারই কূটনৈতিক বাস্তবতায় যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়।
তিনি বলেন, প্রথমেই দেখতে হবে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত বড় নির্ভরতা কোথায়। দেখা যাচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর বাণিজ্য ছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৮৪ মার্কিন ডলার। আর রাশিয়ার সঙ্গে শূন্য দশমিক ৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাণিজ্যের এই বাস্তবতা অবশ্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ফ্যাক্টর।
কভিড-১৯ সংকটেও ইতালিসহ পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনশক্তি নিয়েছে। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র আবর দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ শ্রমশক্তি কাজ করছে বাংলাদেশের। শ্রমবাজারও বাংলাদেশের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে রাশিয়া এবং চীন সরাসারি মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যেটা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে বিব্রতও করেছে। অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোই বাংলাদেশকে সংকট উত্তরণে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে। এই বাস্তবতাও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ফ্যাক্টর।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ চায় দ্রুত ইউক্রেন ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান হোক। শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করুক। সূত্র : সমকাল।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :