ঢাকা : রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবন গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের ঘটনায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের তথ্য পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। স্থানীয় কয়েকজন বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে অগ্নিকান্ডের সঠিক কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। দেশে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। সারা দেশে দুর্ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে। ফলে সিলিন্ডার ব্যবস্থাপনা ও এর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হাজারেরও বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক ক্রেতা গোষ্ঠীর চাপে গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা তুলনামূলক উন্নত হয়েছে। কিন্তু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো চাপ না থাকায় কর্তৃপক্ষের দিক থেকে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘বিস্ফোরক কিংবা রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের পাশাপাশি বাতাসে গ্যাসের উপস্থিতিতে অনেক সময় ভবনে বিস্ফোরণ হতে পারে। সাধারণত এলপিজি গ্যাস ২ শতাংশ ও লাইনের প্রাকৃতিক গ্যাস ৫ শতাংশ বাতাসের সংস্পর্শে এলেই তা ভাসতে থাকে। একপর্যায়ে তা বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাতে পারে। মানসম্মত সিলিন্ডার ব্যবহারের পাশাপাশি জনসচেতনতা এবং রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর তদারকি বাড়ানোর মাধ্যমে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলিন্ডারের মধ্যে এলপি গ্যাস যে চাপ তৈরি করে, তার চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি চাপ সহ্য করার সক্ষমতা রয়েছে মানসম্পন্ন সিলিন্ডারের। এ সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় এটি ব্যবহারের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। ওই মেয়াদের মধ্যে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো ঝুঁকিই নেই বললেই চলে।
সিলিন্ডারে দুর্ঘটনাগুলো মূলত গ্যাসের লিকেজ থেকে ঘটে। হোসপাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভ ইত্যাদিতে দুর্বলতার কারণে যেকোনো সময় গ্যাস লিক হতে পারে। সেই লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাস সামান্য আগুন এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি সিলিন্ডারগুলো যথাযথভাবে পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহার না করা এবং মানহীন মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত বছর চুলার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ২১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে তা ছিল ৯৪টি। এসব ঘটনায় হতাহতের পাশাপাশি মূল্যবান মালামালেরও ক্ষতি হয়। এর আগের বছরগুলোতেও এ পরিসংখ্যান ছিল উদ্বেগজনক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সিলিন্ডার পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু দেশে এ নিয়ম মানা হয় না। অধিকাংশ সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় না। আবার পরীক্ষা করা হলেও তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। একটা সিলিন্ডারও পরীক্ষায় ফেল করে না। এটা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার।
পাশের দেশ ভারতে বাসাবাড়িতে ব্যবহারের জন্য বিপুল পরিমাণে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হলেও সে দেশে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা ঘটে খুবই কম। কারণ সেখানে সিলিন্ডার ও এর যন্ত্রাংশের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পাশাপাশি সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভারতীয়রা অনেক সচেতন। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশের সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারকারীদের মধ্যে এখনো সেই সচেতনতা তৈরি করা যায়নি।
বেইলি রোডে যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সেখানে পাঁচটি রেস্টুরেন্ট ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট ছিল। রেস্টুরেন্টগুলোতে এলপিজি গ্যাস ব্যবহা করা হতো। ভবনের সিঁড়িতে সারি সারি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল।
এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার নিয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিছু সতর্কতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সেগুলো হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার কোনো পাটাতনের ওপর না রেখে সমতল জায়গায় খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। আশপাশে কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে সেটিও খেয়াল রাখা দরকার। চুলা, সিলিন্ডার থেকে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি ওপরে রাখতে হবে এবং লম্বা পাইপের সাহায্যে চুলা থেকে অন্তত তিন ফুট দূরে স্থাপন করতে হবে সিলিন্ডারটি। এটি ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন চুলা চালু না থাকে। সিলিন্ডারটি স্থানান্তরের সময় টানাহেঁচড়া, ধাক্কা দেওয়া কিংবা মাটিতে গড়ানো যাবে না।
এগুলোর পাশাপাশি আরও যেসব বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার তা হলো সিলিন্ডারের আশপাশে আগুন জ্বালানো, ধূমপান করা থেকে বিরত থাকা। সিলিন্ডারের ওপরে ভারী বোঝা রাখা যাবে না। রান্না শুরুর আধঘণ্টা আগে রান্নাঘরের দরজা-জানালা খুলে দেওয়া এবং রান্না শেষে চুলার নব ও এলপিজি সিলিন্ডারের রেগুলেটর সুইচ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
অনেক দিনের বদ্ধ ঘরে প্রবেশের পর সবার আগে দরজা-জানালা খুলে দিতে হবে। যদি ঘরের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায় তাহলে জানালা-দরজা খুলে দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যে ম্যাচের কাঠি জ¦ালানো, ইলেকট্রিক সুইচ, সিলিন্ডারের রেগুলেটর কিংবা মোবাইল ফোন অন বা অফ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেকে সিলিন্ডারে লিকেজ খোঁজার সময় মোমবাতি কিংবা ম্যাচের কাঠি ব্যবহার করেন। সেটা কোনো অবস্থাতেই করা যাবে না।
বছরে অন্তত একবার গ্যাস সিলিন্ডার এবং এর সঙ্গে ব্যবহার হওয়া নানারকম সামগ্রী নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। কোনো যন্ত্রাংশ দুর্বল থাকলে তা বদলাতে হবে দ্রুত। অনেকে সামান্য কিছু টাকা সাশ্রয় করতে গিয়ে কমদামের মানহীন পণ্য কেনে যার ফলে বিপত্তি ঘটে।
এরপরও যেকোনো ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাসা, বিশেষ করে রান্নাঘরের মধ্যে নিরাপত্তামূলক বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি যেমন গ্যাস ডিটেক্টর এবং ফায়ার এক্সটিংগুইশার কিংবা হাতের কাছে কম্বলের মতো মোটা কাপড় রাখা যেতে পারে।
গ্যাস সিলিন্ডার, রেগুলেটর, পাইপ কেনার সময় সত্যায়িত সার্টিফাইড কোম্পানি কিংবা অনুমোদিত বিক্রেতাদের থেকে কেনা উচিত বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সবার আগে দেখতে হবে সিলিন্ডারের গায়ে মেয়াদ দেওয়া আছে কি না। সাধারণত একটি সিলিন্ডার ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া থাকে। যেটা সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। সেই সঙ্গে কোম্পানির সিল, সেফটি ক্যাপ, পাইপ রাবারের রিং, রেগুলেটর ঠিকভাবে আছে কি না, সেটা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমোদিত অনেক প্রতিষ্ঠান সিলিন্ডার তৈরি করে বাজারজাতের পাশাপাশি অলিগলির দোকানেও পুরনো সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। আবার অনেকে অনুমোদন ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে তা বিক্রি করছে। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারে রঙ করে নতুন বলে তা বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। মানহীন এসব সিলিন্ডার বিক্রি হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বেইলি রোডের আগুন লাগা ভবনটির সিঁড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার থাকার কারণে পুরো সিঁড়িটি ‘অগ্নিচুল্লির’ মতো হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে নামতে পারেনি।
আগে থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এম আনসার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ ভবন তৈরির সময় নির্মাতারা গুণগত মানের চেয়ে কত কম খরচে বেশি টাকা আয় হবে সেই চিন্তা করেন। এখানে মানুষের জীবনের দাম আমলে নেওয়া হয় না। অথচ যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার সবার আগে।’
যুক্তরাজ্য প্রবাসী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রকৌশলী ড. নাসির উদ্দীন খান বলেন, ‘রাজধানীর অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। বেশিরভাগ ভবন কাচ দিয়ে ঘেরা থাকায় বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে অনেক সময় এলপিজির পাশাপাশি জমে থাকা নানারকম গ্যাসের কারণেও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে।’
পরিবেশ দূষণ কমাতে ২০০০ সালে দেশে যানবাহনে গ্যাসের ব্যবহার এবং রান্নার কাজে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালের দিকে।
বর্তমানে দেশে ৬০ লাখের বেশি এলপিজি ব্যবহারকারী রয়েছেন। আর এলপিজি সিলিন্ডার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। ২০১০ সালে আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধের পর থেকে বাসাবাড়িতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে গ্যাস সংকটের কারণে পাইপলাইনে গ্যাসের গ্রাহকদের অনেকেই এলপিজি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন। সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :