ঢাকা : গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। আন্দোলন ঠেকাতে শত শত মানুষ হত্যার অভিযোগ ওঠে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে।
মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে যেসব হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আর এই বিচারকে অগ্রাধিকার তালিকায় স্থান দেওয়ার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে কবে নাগাদ মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে, তা নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা ও কৌতূহল রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্তত চারজন প্রসিকিউটর এবং ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে।
আলাপকালে তদন্তকাজের সর্বশেষ অগ্রগতি, বিচার শুরুর সময় ও প্রক্রিয়া এবং শুনানি শেষে রায় কবে নাগাদ হতে পারে, সেসব বিষয়ে কিছু ধারণা পাওয়া গেছে।
প্রসিকিউটররা বলেছেন, কাক্সিক্ষত সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আগামী এপ্রিলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হতে পারে। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্কের শুনানি শেষ করবেন তারা। আর এসব ধাপ শেষে ২০২৫ সালের শেষের দিকে রায় আশা করছেন তারা।
প্রসিকিউটরদের ভাষ্য, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ‘নিউক্লিয়াস’ শেখ হাসিনা এমনটি ধরে নিয়েই তার মামলার বিচারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আপাতত মানবতাবিরোধী অপরাধের তিনটি মামলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার নিষ্পত্তির কার্যক্রম চলছে। একটি মামলায় শেখ হাসিনা একমাত্র আসামি।
আরেকটিতে তার সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতা, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও সাবেক আমলাসহ আসামি ৪৬ জন। অগ্রাধিকার পাওয়া আরেকটি মামলায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আসামি ২৭ জন। প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
একই দিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে।
পরোয়ানাভুক্তদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, সাবেক মন্ত্রী, ১৪-দলীয় জোটের নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সাবেক আমলা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২০ জনের বেশি আসামিকে ইতিমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনার বিষয়ে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারির জন্য প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগে পুলিশের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছে।
ওবায়দুল কাদেরও পলাতক রয়েছেন। শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনতে না পারলে বা তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির না হলে আইন অনুযায়ী তার অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে। তবে, পলাতক ব্যক্তিরা রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী পাবেন বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটররা।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত সোম ও মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের দপ্তরে গেলে জরুরি কাজে বাইরে থাকায় তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। পরে তার মোবাইল ফোনে কল করেও কোনো সাড়া মেলেনি।
শেখ হাসিনার বিচার প্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম গত ২২ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অন্তত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন হবে। তবে, এটা কোনো চূড়ান্ত কথা নয়। তদন্ত রিপোর্ট হাতে এলেই আমরা বলতে পারব আনুষ্ঠানিক বিচার কবে শুরু হবে।’
ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির বক্তব্যের সমর্থনে একাধিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তড়িঘড়ি বিচারের পক্ষে নয় প্রসিকিউশন। ত্রুটিমুক্ত ও স্বচ্ছ তদন্ত করতে একটু সময় লাগবে। তদন্তকাজ কাক্সিক্ষত সময়ে শেষ করতে তদন্ত সংস্থাকে তারাও সহযোগিতা করছেন।
তারা আরও বলেন, ‘কবে বিচার শুরু হবে তা নির্ভর করছে কত দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসবে তার ওপর। তিন থেকে চার মাস লাগতে পারে। এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে ও আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হলে আগামী বছরের শেষ দিকে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই রায় হতে পারে।’
প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ‘তদন্তকাজ শেষ করতে তিন থেকে চার মাসের বেশি লাগবে না এবং শুনানি শেষে এক বছরের কম সময়ে রায়ের আশা করছি। প্রাথমিকভাবে শেখ হাসিনা ও গণহত্যায় একই ধরনের দায়ে যারা অভিযুক্ত, তাদের মামলাগুলো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিচারের সময় কোনো আসামি উপস্থিত না থাকলে স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ার (রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী) তাদের পক্ষে শুনানি করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মামলাগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি, সাক্ষীর সংখ্যা ৫০ জনের বেশি নাও হতে পারে।’
প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে নিহতদের স্বজন, আহত ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন অর্থাৎ গণহত্যার ভৌগোলিক এলাকার মাধ্যমে।’
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘ঢাকা কিংবা তার আশপাশে যাত্রাবাড়ী, উত্তরাসহ বেশ কিছু এলাকায় গণহত্যা হয়েছে। ঘটনার অনেক ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের অনেকের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এসবের ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণের চেষ্টা করা হবে।’
বিচারের বিষয়ে একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক মো. মাজহারুল হক। তিনি বলেন, ‘ঘটনার ভুক্তভোগী, সাক্ষীদের বক্তব্য নেওয়া, তথ্য-প্রমাণ ও আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি তদন্ত শেষ করা যায়। তবে, নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলা যাবে না। প্রসিকিউশন যা বলেছে আমাদের বক্তব্য ওরকমই।’
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাক্ষী করার উদ্যোগ : একাধিক প্রসিকিউটর দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভিন্নমত পোষণ করা সুশীল সমাজের যেসব প্রতিনিধি নিগ্রহ, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, গণ-অভ্যুত্থানে সুশীল সমাজের যেসব প্রতিনিধি সমর্থন জানিয়েছিলেন, তারাসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সাক্ষ্য দিতে অনুরোধ জানানো হবে। প্রাথমিকভাবে বেশ কয়েকজনের নাম বাছাই করা হয়েছে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে অপশাসন, গুম, খুন ও অপরাজনীতির এবং গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ছিলেন সামনের সারিতে এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের ফ্যাসিজমে সুশীল সমাজের যারা ভুক্তভোগী, যাদের কাছে তথ্য আছে এবং জুলাই- আগস্ট আন্দোলনে যারা সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সেসব ব্যক্তি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের সাক্ষী হিসেবে আনা হবে। কারণ তারা গণ-অভ্যুত্থানের অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :