ঢাকা : বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের সংখ্যা। এ কারণে বছরে বাড়তি খরচ হচ্ছে ৫ হাজার ৭১ কোটির বেশি টাকা। এত খরচ করার পরও এই অপ্রয়োজনীয় সিজার মা ও শিশু উভয়ের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
অপরদিকে স্বাভাবিক নিয়মে প্রসব হলে সন্তান কিছু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়েই ভূমিষ্ঠ হয়, শাল দুধ খেতে পারে। কিন্তু অস্ত্রোপচার বা সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম হলে সন্তান এই সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। উপরন্তু সন্তান জন্মদানে পিতা-মাতাকে বিশাল খরচের ভারও বহন করতে হচ্ছে।
বছরে সাড়ে ৮ লাখের বেশি অপ্রয়োজনীয় সিজার হয় : বালাদেশে বছরে ১০ লাখের বেশি শিশুর জন্মে হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় সিজারে (বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২)।
অপরদিকে শিশুদের নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশে ২০১৮ থেকে ২০১৯ এই দুই বছরে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ানের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৮ লাখ ৬০ হাজার অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হয়েছে।
অপরদিকে ৩ লাখ নারীর জটিলতার কারণে সিজারিয়ানের প্রয়োজন হলেও তারা তা পাননি। জীবন বাঁচানোর জন্যই এই ৩ লাখ মায়ের সিজারিয়ান ডেলিভারি সুবিধার প্রয়োজন ছিল।
সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, অপ্রয়োজনীয় এই সিজারিয়ান করার কারণে বাংলাদেশে বছরে ব্যয় হচ্ছে ৫ হাজার ৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকা (৪৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার)। সেভ দ্য চিলড্রেনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৬ থেকে ২০১৮ এই ৩ বছরে আগের তুলনায় সিজারিয়ান ৫১ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৪ সালে এই অস্ত্রোপচারের হার ছিল ৪.৩১ শতাংশ।
সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে সম্পদশালীরা বেশি মাত্রায় সিজারিয়ানের দিকে ঝুঁকছে, যদিও তা মা ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর ও একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে সিজারিয়ান বেড়েছে। তবে সে দেশগুলোতে সিজারিয়ান করা হয় মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস করার উদ্দেশ্যে।
বাংলাদেশে সিজারিয়ানের ফলে যে হারে মাতৃমৃত্যু কমা উচিত ছিল তা হয়নি। বাংলাদেশের সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৭-১৮) অনুযায়ী, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ১৯৬ জনের মৃত্যু হচ্ছে।
সিজারিয়ানের কয়েকটি ঝুঁকি : সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানে রয়েছে নানা রকম ঝুঁকি। গাইনিকোলজিস্টরা বলছেন, সিজারিয়ানে মা ও শিশু উভয়কেই অস্ত্রোপচারের নানা রকম ঝুঁকিতে পড়তে হয়। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ফলে মায়ের নানা ধরনের সংক্রমণ ও মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ঘটে থাকে। তখন মাকে রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে। একই সঙ্গে অঙ্গহানি, জমাট রক্ত ইত্যাদির কারণে মায়েদের সুস্থতা ফিরে পেতে দীর্ঘ সময় লাগে।
এছাড়া সিজারিয়ানের কারণে প্রাকৃতিক জন্মের লাভজনক দিকগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। গাইনিকোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. হামিদা বেগম বলেন, মায়ের প্রসবের পথ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে শিশুর জন্ম হলে শিশুর শরীর কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া গ্রহণ করতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে দেয়। অস্ত্রোপচার বা সিজার করা হলে এই সুবিধাটি শিশু গ্রহণ করতে পারে না এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া পায় না।
এ ছাড়া মায়ের বুকের দুধ পান করার জন্য মায়ের সঙ্গে শিশুর যে শারীরিক নৈকট্যে আসা দরকার, সিজারিয়ানে জন্মালে শিশুটি সে সুবিধা দেরিতে পায়। মায়ের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য শিশুকে তখন কিছু সময় মা থেকে দূরে রাখা হয় বলে শিশু মায়ের শাল দুধও পায় না। আবার বুকের দুধও পায় না অথবা কম পায়।
বেসরকারি হাসপাতালে ৮০ শতাংশই সিজার : সেভ দ্য চিলড্রেনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে যত সিজারিয়ান হয়েছে তার ৭৭ শতাংশই অপ্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু তারপরও এমন সিজারিয়ান হচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেন এই প্রবণতার জন্য আংশিকভাবে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা খাতের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে।
সংস্থাটি বলছে, এছাড়া কিছু অসৎ ও অনৈতিক চিকিৎসক এর জন্য দায়ী। অসৎ ও অনৈতিক চিকিৎসকরা স্বাভাবিক প্রসবে সহায়তা না করে মা ও অভিভাবকদের সিজার করাতে বাধ্য করে।
এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা গাইনির চিকিৎসকদের বাধ্য করেন সিজারিয়ানে সন্তান জন্ম দিতে। গাইনিকোলজিস্টকে শর্ত দেওয়া হয়, ‘সিজার করতে পারলেই তিনি এখানে প্র্যাকটিস করতে পারবেন।’ তিনি বাধ্য হয়ে কাজটি করেন।
নরসিংদীতে সরকারি চাকরি করেন এমন একজন গাইনিকোলজিস্ট বলেছেন, তিনি বিকালে ও রাতে যে বেসরকারি হাসপাতালে প্র্যাকটিস করেন সেখানে তাকে বাধ্য করা হয় সিজার করতে।
তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, নরসিংদীর সবগুলো হাসপাতালে একই নিয়ম। প্রসব বেদনা নিয়ে কোনো মা হাসপাতালে আসলেই প্রথমে হাসপাতালের নার্স ও অন্যরা প্রসব বেদনায় কাতর মাকে কিছুটা চেক করে মুখস্থ বলে দেয়, পানি কমে গেছে, শিশু বাঁচবে না দ্রুত সিজার না করতে পারলে। এদের এসব কথায়, ভয়ে মা ও অভিভাবকরা সিজার করিয়ে ফেলেন। এ ক্ষেত্রে গাইনিকোলজিস্টদের কিছুই বলতে হয় না, তিনি গিয়ে সিজার করে তার দায় সারেন।
সিজার অনেকের কাছে ফ্যাশনও : বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে সিজারের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। সিজার বৃদ্ধির কারণে কিছু মা ও শিশুর জীবন বাঁচানো সহজ হয়েছে বটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় সিজার যে হচ্ছে না তাও নয়। এর অনেকগুলো কারণ আছে বলে তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন। গ্রামে এখনো ১৮ বছরের আগে মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে। গাইনি কনসালট্যান্ট শারমিন আক্তার বলছেন, অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়ার কারণে মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি বাড়ে।
এ কারণে সন্তান জন্ম দিতে আসা অনেক মেয়েই ডাক্তারের কাছে এসেই বলেন, আমাকে সিজার করে ফেলুন, আর এই সুযোগে ডাক্তারও সময় ব্যয় না করে মাকে কাউন্সেলিং না করে সিজার করে ফেলেন।
আবার অনেক মেয়ে অথবা পরিবার নিজেদের সামাজিক স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্য দামি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করেন, সিজারে তাদের আপত্তি থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসচেতন মা প্রসব বেদনা থেকে মুক্তি পেতে সিজারে অনাপত্তি জানালে কাজটা সহজেই হয়ে যায়।
ডা. শারমিন আক্তার জানান, লেখাপড়া জানা ২৫ বছরের বেশি বয়সী মেয়েরা জটিলতায় বেশি ভোগে। ফলে চিকিৎসককেও বাধ্য হতে হয় সিজার করে ফেলতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়বেটিসও ধরা পড়ে বলে অনাগত সন্তানের কথা বিবেচনায় নিয়ে সিজারে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করতে হয়।
সিজারের জটিলতাগুলোর মধ্যে সংক্রমণ অন্যতম। অনেকের রক্তপাতও হতে পারে। তাছাড়া ভূমিষ্ঠ শিশুর জটিলতা বেড়ে যেতে পারে। এর মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা বা নিউমোনিয়া হতে থাকে। এনাসথেশিয়া দিয়ে অজ্ঞান করার পর অন্য ধরনের আরেক জটিলতায় মায়েরা ভোগেন।
গ্রামে সিজার বেড়েছে ২৭ শতাংশ : ২০০৪ থেকে ২০১৮ এই ১৪ বছরে গ্রামে সিজারিয়ান বেড়েছে ২৭ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। বিআইডিএসের গবেষণা বলছে, ২০০৪ সালে গ্রামে সিজারে সন্তান জন্মদানের হার ছিল ২ শতাংশ। কিন্তু ২০১৮ সালে হার বেড়ে ২৯ শতাংশে পৌঁছেছে। বিআইডিএস এটাকে উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করেছে।
প্রশিক্ষিত ধাত্রী কমিয়ে দিতে পারে সিজারিয়ান : প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা ধাত্রী বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন কোর্স সম্পন্নরা সিজারিয়ান কমিয়ে দিতে পারে। দেশে প্রয়োজনীয় ধাত্রী থাকলে তারা মাকে সন্তান গর্ভ ধারণের পর থেকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুসারে সেবা দেবেন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবে সহায়তা করবেন। উন্নত দেশগুলোতে এই ব্যবস্থা রয়েছে বলে সেখানে সিজারিয়ানের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম।
বাংলাদেশে এক সময় বাড়িতে ধাত্রীর কাছে সন্তান জন্মদানের স্বাভাবিক নিয়ম ছিল। তবে সে ধাত্রীদের আধুনিক জ্ঞান ছিল না। ফলে ধাত্রীর অনভিজ্ঞতার কারণে অনেক মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যু হতো। এই ধাত্রীদের সন্তান প্রসবে ন্যূনতম জ্ঞান দেওয়া হলে তারা বাড়িতেই সন্তান প্রসবে সহায়তা করতে পারবেন। প্রশিক্ষিত ধাত্রী থাকলে তারা মায়েদের কাউন্সেলিং করে স্বাভাবিক প্রসবে উৎসাহিত করতে পারবেন। এটা হলে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের সংখ্যা কমে যাবে বলে অধ্যাপক ডা. হামিদা বেগম জানিয়েছেন।
এছাড়া বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল মিডওয়াইফারি বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন কোর্স চালু করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কিছু ধাত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এদের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি নয়। কিন্তু নিরাপদ প্রসবের জন্য বাংলাদেশের কমপক্ষে ২২ হাজার মিডওয়াই বা ধাত্রীর প্রয়োজন। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :