ঢাকা : দশ বছর বয়সী মেহরিমা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত; প্রতি ২৫ দিন পর তাকে এক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। কিন্তু রক্তদাতা না পেয়ে তার বাবা শহীদুল ইসলাম গত বুধবার ঢাকার শান্তিনগরে কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংকে যান রক্তের খোঁজে।
পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান শহীদুল ইসলাম থাকেন ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। তবে মেহরিমা তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলায় মায়ের সঙ্গে থাকে। রক্ত দিতে ঢাকায় এসেছে সে।
শহীদুল ইসলাম বলেন, বছরের অন্য সময় সহজেই রক্তদাতা পান তিনি। কিন্তু রোজার সময় ‘ডোনার’ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের কাছ থেকে রক্ত নিতাম। তাদের নিয়া হাসপাতালে গিয়া রক্ত দিলে আমার খরচটা একটু কম লাগে। কিন্তু রোজার মাসে তারা রক্ত দিতে চায় না। মানুষ রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এজন্য ব্লাড ব্যাংকে আসছি, উনারা কোনোভাবে জোগাড় করে দেন।
ঢাকার বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকে কথা বলেও একই চিত্র পাওয়া গেল। রোজা আসার পর রক্তাদাতার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। চাহিদা অনুযায়ী রক্ত সরবরাহ করতে না পেরে বিপাকে আছেন তারাও।
রোজা রেখে রক্ত দিতে ধর্মীয় কোনো বিধিনিষেধ নেই। রোজা রেখে রক্ত দিলে শারীরিক কোনো সমস্যাও হয় না। তারপরও সচেতনতার অভাব কিংবা ভয়ে রোজা রেখে রক্ত দিতে চান না অনেকে। আর তাতেই রমজান এলে দেশে জীবন রক্ষাকারী রক্তের সঙ্কট তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রমজানে রক্তদান স্বাভাবিক রাখতে মানুষকে সচেতন করতে হবে। রক্তের সঙ্কট কাটাতে উদ্যোগ নিতে হবে স্বাস্থ্য বিভাগকেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হয়। তবে বিশ্ষেজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা এরচেয়ে অনেক বেশি, কারণ বেসরকারি অনেক ব্লাড ব্যাংক তাদের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেয় না।
সঙ্কটের মাত্রা কেমন : ফরিদপুরের নগরকান্দা থেকে শুধু রক্তের জন্য ছয় বছর বয়সী ইব্রাহিম শেখকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন ইমরান শেখ। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ইব্রাহিমকে ২১ দিন পরপর রক্ত দিতে হয়। সেখানে রক্ত জোগাড় করা কঠিন, রমজান মাসে তা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
ইমরান বলেন, কোয়ান্টামে যোগাযোগ করলে তারা জোগাড় কইরা দেয়। আজ সেহরি খেয়ে ভোরে বাচ্চাকে নিয়া রওনা হইছি। রক্ত দিয়া আইজ আবার বাড়িতে ফেরত যামু।
রক্ত না পেয়ে সময়মত অস্ত্রোপচারও করা যায় না অনেক সময়। বিশেষ করে ‘নেগেটিভ’ গ্রুপের রক্তগ্রহীতারা এই সঙ্কটে পড়েন বেশি।
ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি শিশু খাদিজা আক্তার তুলির অস্ত্রোপচার করার কথা ছিল ১০ মার্চ। এজন্য তিন ব্যাগ ‘এ-নেগেটিভ’ রক্ত প্রয়োজন ছিল তার। কিন্তু রক্ত না পাওয়ায় অস্ত্রোপচার বারবার পেছাতে হয়েছে।
খাদিজার মা হাসিনা বেগম বলেন, রক্ত পাই নাই বইলা অপারেশন হয় নাই। আমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করছি, কান্নাকাটি করছি। পরে ব্যাংকের ম্যাডামরা রক্ত জোগাড় করে দিছে। কাল (বুধবার) অপারেশন হইছে। এই কয়দিন মাইয়া অনেক কষ্ট করছে।
কোয়ান্টামের স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের সংগঠক শামীমা নাসরিন মুন্নী বলেন, জানুয়ারিতে ৩৫৩৬ ব্যাগ, ফেব্রুয়ারিতে ৩৫২৫ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেছেন তারা। আর মার্চ মাসে ২০ তারিখ পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ১৯৮৮ ব্যাগ রক্ত।
রোজার শেষ দিকে রক্ত সংগ্রহ একেবারেই কমে যায়। সে হিসেবে এ মাসে রক্ত সংগ্রহ দুই হাজার ব্যাগের বেশি হবে না।
তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে রোগীরা সমস্যায় পড়ছেন। ব্লাড ব্যাংকগুলোও রক্ত দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
রোজায় রক্ত সংগ্রহ কমে, কিন্তু চাহিদা তো কমছে না। ফলে আমাদের এখানে রক্ত নিতে আসা রোগীদের লাইন বেড়ে যাচ্ছে। আজ যিনি ডিমান্ড দিলেন, তিনি রক্ত পাবেন দুই বা তিনদিন পর। এতে আমাদের চেয়ে বেশি মুশকিলে পড়ছেন রোগীরা।
দেখা গেছে, যে রোগীর অপারেশন আজকেই হওয়ার কথা ছিল, রক্ত না পেয়ে পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে আমাদের কাছে অন্তত ৫ জন এসেছেন, রক্ত না পেয়ে যাদের (স্বজনদের) বাইপাস সার্জারির মত অপারেশন পিছাতে হয়েছে।
রমজান মাসে রক্তদাতা কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ বললেন বাঁধন কেন্দ্রীয় পরিষদের উপদেষ্টা মো.সাঈদুর রহমান ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, রক্তদাতাদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ থাকায় তাদের বড় অংশ বাড়িতে চলে যায়। এতে রোজায় অন্য সময়ের চেয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ রক্ত সংগ্রহ কম হয়।
রোজা রেখে অনেকে রক্ত দিতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন, শরীর দুর্বল হয়ে যাবে এমনটা মনে করেন। কিছুক্ষেত্রে কেউ কেউ এটাকে ধর্মীয় বাধা মনে করেন। যারা নিয়মিত ডোনার, তারা অবশ্য রোজায় রক্ত দেন। কিন্তু অনিয়মিত ডোনার বা নতুন ডোনার যারা, তাদের রক্তদানের পরিমাণ রোজার সময় কমে যায়।
রক্ত পেতে এই ভোগান্তির বিষয়টা আবার রোগীর স্বজনরা ততটা বুঝতে পারেন না। কারণ তারা রিকুইজিশন দেন আমরা যেভাবেই হোক সেটা ম্যানেজ করে দিই। আগে যেখানে ৫ জনকে নক করতাম, এখন রক্তের জন্য ২০ জনকে নক করতে হয়। সেটা গ্রহীতার স্বজনদের পর্যন্ত পৌঁছায় না।
সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুকাররাবিন হক নিবিড় বলেন, রোজা রেখেও যে রক্তদান করা যায় এ বিষয়টি অনেকে জানেন না। এ কারণে রক্ত দিতে চান না। এ কারণে আমরাও ডোনার সঙ্কটে পড়ি।
মুকাররাবিন হক নিবিড় বলেন, জানুয়ারি মাসে তাদের ৪৭৩৫ ব্যাগ, ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৬৪০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ হয়েছে। আর মার্চের প্রথম ১৫ দিনে সংগ্রহ হয়েছে ২৬৩০ ব্যাগ রক্ত।
১৫ রোজার পর রক্ত সংগ্রহের পরিমাণ কমে যায়। সে হিসেবে গত দুই মাসের চেয়ে মার্চ মাসে রক্ত সংগ্রহ অনেক কম হবে।
শাস্ত্র কী বলে?
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান মুফতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, দুর্ঘটনায় আহত বা অসুস্থ রোগীর জন্য রক্ত খুবই জরুরি। রোজা রেখে রক্ত দেওয়া, নেওয়ায় ধর্মীয় কোনো বাধা নেই।
রক্ত একশবার দেওয়া যাবে, রক্ত দেওয়া সওয়াবের কাজ। রোজার সময় রক্ত দিলে কোনো ক্ষতি নেই। নিতেও কোনো বাধা নেই। তবে রক্ত খুব বেশি পরিমাণে দিলে সেটার কারণে যদি শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, রোজা ভেঙে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে-ওই পরিমাণে বেশি দেওয়াটা মাকরুহ বা অপছন্দনীয়। নাজায়েজ নয়।
তিনি বলেন, রোজাদারদের প্রতি আমার আহ্বান, জনস্বার্থে, জনগণের কল্যাণে, সওয়াবের জন্য রক্ত দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্ঘটনা অব্যাহতভাবে হতেই থাকবে, মানুষেরও রক্তের প্রয়োজন থাকবেই।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের প্রধান ডা. আশরাফুল হক বলেন, রোজার সময় রক্তের অভাব প্রতিদিন অসংখ্য পরিবারের কাছে চরম বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই মনে করেন, রোজা রেখে রক্তদান করলে দুর্বল হয়ে যাবেন, কেউ কেউ দ্বিধায় থাকেন–রোজা ভেঙে যাবে কি না।
রক্তদান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং এটি শরীরের রক্ত উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও সক্রিয় করে। তবে রোজার মধ্যে রক্তদানের কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে এটি আরও নিরাপদ হয়।
রোজায় রক্তদানে মাথায় রাখতে হবে যেসব বিষয়
• রক্তদানের সঠিক সময়: ইফতারের পর বা সেহরির পরে রক্তদান করা সবচেয়ে ভালো, কারণ তখন শরীর পানি ও পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার হতে পারে।
• পানিশূন্যতা এড়ানো: রক্তদানের আগে ও পরে পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খাওয়া উচিত।
• পুষ্টিকর খাবার: রক্তদানের পর শক্তি ফিরে পেতে আয়রনসমৃদ্ধ খাবার যেমন খেজুর, দুধ, ফলমূল ও সবুজ শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন।
• বিশ্রাম নেওয়া: রক্তদানের পর অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া ভালো, বিশেষ করে গরমের দিনে।
আশরাফুল হক বলেন, রমজানে রক্তদাতা কমে যাওয়ায় অনেক রোগী সঙ্কটে পড়েন। সেজন্য ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখা জরুরি।
এড়িয়ে না গিয়ে উপযুক্ত সময়ে রক্তদানের পরিকল্পনা করা। পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের রক্তদানে উৎসাহিত করা। স্থানীয় ব্লাড ব্যাংক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করা। রমজানের আগে ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রক্ত মজুদ বাড়ানো উচিত। হাসপাতাল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো ইফতারের পর বিশেষ রক্তদান ক্যাম্প আয়োজন করতে পারে। টেলিভিশন, রেডিও ও সামাজিক মাধ্যমে রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রচার চালানো। জরুরি পরিস্থিতিতে সমন্বয়: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রক্তদাতা ও প্রয়োজনীয় রোগীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা।
প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে একটি পরিকল্পনা করবেন তারা।
এর সমাধান হতে পারে রোজার আগেই বেশি পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করে রাখা হলে। এ বছর তো রোজা প্রায় শেষের দিকে। আগামী বছর এ ধরনের সঙ্কট মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখব। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বলে রাখব এ বিষয়ে যেন আগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। সূত্র : বিডিনিউজ
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :