সিরিয়ায় ইসরায়েল কী চায়

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৬:৪১ পিএম
সিরিয়ায় ইসরায়েল কী চায়

ঢাকা : বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে গত রোববার ক্ষমতা ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। এরপর থেকেই প্রতিবেশী দেশটির অভ্যন্তরে আগ্রাসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এ পর্যন্ত বিভিন্ন লক্ষ্যে চার শতাধিকবারের বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে ইসারয়েল। 

জাতিসংঘের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাফার জোন পেরিয়ে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কাছাকাছি চলে এসেছে ইসরায়েলি সেনারা। তবে সিরিয়ায় হামলার পেছনে ইসরায়েলের উদ্দেশ্য কী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিয়ায় আসলে কী চায় ইসরায়েল?

আল-জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়, সিরিয়া নিয়ে ইসরায়েলের মাথাব্যথা অনেক দিনের। আসাদের পতনের আগে ইসরায়েল ২০১৩ সাল থেকে সিরিয়ায় ২৫০টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে। এই হামলাগুলো মূলত ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া এবং দেশটির সামরিক স্থাপনার ওপর চালানো হয়েছে। যাতে ইরান সিরিয়ার ভেতর শক্তি বৃদ্ধি করতে না পারে। ১৯৮১ সালে দখলকৃত গোলান মালভূমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণের পর ইসরায়েল দামেস্কের কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু আসাদের পতনের আগেই ইরান সিরিয়া থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়।

তবে ইসরায়েল তাদের পদক্ষেপগুলোকে আত্মরক্ষামূলক বলে দাবি করলেও, এই আক্রমণ এবং বাফার জোনের সম্প্রসারণ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনা সৃষ্টি করেছে।

সিরিয়ায় হামলা কেন : দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এর পেছনে দেশটির অজুহাত, সিরিয়ায় ইরানের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলো ধ্বংস করতেই হামলাগুলো চালায় তারা। যদিও ইরান বলেছে, সিরিয়ায় তাদের সামরিক বাহিনীর কোনো উপস্থিতি নেই। 

সম্প্রতি সিরিয়ায় চালানো হামলার পেছনের কারণ হিসেবে ইসরায়েল বলছে, তাদের লক্ষ্য হলো দেশটির সামরিক বাহিনীর সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা। তারা চাচ্ছে, সিরীয় বাহিনীর অস্ত্রগুলো যেন ‘চরমপন্থিদের’ হাতে না পড়ে।

কোথায় কোথায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল : ইসরায়েল বলছে, তারা সিরিয়ার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রাগার, গোলাবারুদ সংরক্ষণাগার, বিমানবন্দর, নৌঘাঁটি ও গবেষণাকেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। সিরিয়া ও ইসরায়েলকে আলাদা করা গোলান মালভূমি সংলগ্ন বাফার জোনেও সেনা মোতায়েন করেছে তারা। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের অস্ত্রবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে এই বাফার জোনকে নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

গোলান মালভূমির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ইসরায়েলের দখলে। বাশারের পতনের পর বাফার জোনের ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাও তারা দখলে নিয়েছে। গোলান মালভূমির অবশিষ্ট এলাকার নিয়ন্ত্রণ সিরিয়ার কাছে।

তবে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, ইসরায়েলের সাঁজোয়া যান গোলান মালভূমি থেকে সিরিয়ার ভূখণ্ডের ১০ কিলোমিটার ভেতরের কাতানা এলাকার দিকে অগ্রসর হয়েছে। এই এলাকা রাজধানী দামেস্কের খুব কাছে অবস্থিত।

বাশার সরকারের পতনের পর দামেস্কের শতাধিক স্থানে হামলার পাশাপাশি দেশটির পূর্বে আল-মায়াদিন, উত্তর-পশ্চিমের তারতাস ও মাসায়াফ, লেবানন সীমান্তের কাসার ক্রসিং এবং দক্ষিণের সামরিক বিমানবন্দর খালখালাহতেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।

সিরিয়ায় কী চায় ইসরায়েল : সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার পেছনে কী কারণ তা স্পষ্ট নয়। সরকার বলছে, ‘ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার স্বার্থে’ সিরিয়ায় হামলা করছে তারা। এর বাইরে এমন কিছু বলেনি যা থেকে সিরিয়া ঘিরে দেশটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

তবে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, সে বিষয়ে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। তাদের একজন ইসরায়েলের ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির নেতা এবং নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেনি গানৎস। গত সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সিরিয়ায় হামলা চালানোটা ইসরায়েলের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ ছিল। তিনি দ্রুজ, কুর্দিসহ সিরিয়ার অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

সোমবার ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সাবেক এক সদস্য এবং গবেষকের সাক্ষাৎকার নেয় সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েল। তার প্রত্যাশা, বেনি গানৎসের চেয়ে বেশি। ওই গবেষকের মতে, সিরিয়া ছোট ছোট কয়েক অঞ্চলে ভাগ হয়ে যেতে পারে। প্রতিটি অঞ্চল ইসরায়েলসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।

ডানপন্থি আদর্শগত দাবি : ইসরায়েলের ডানপন্থি মন্ত্রীরা, যেমন বেজালেল স্মোত্রিচ, ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল’ ধারণার পক্ষে বয়ান তৈরি করতে চান। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে গোলান মালভূমির বাইরেও, এমনকি দামেস্ক পর্যন্ত ইসরায়েলের সীমান্ত সম্প্রসারণের দাবি করে। তবে এই দাবিগুলো যতটা আদর্শগত ততটা বাস্তব নয়।

স্মোত্রিচের এই ধারণা ডানপন্থি ইসরায়েলিদের একটি অংশের মধ্যে জনপ্রিয়। তবে তা সাধারণ ইসরায়েলি জনগণ এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পায়নি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে স্মোত্রিচের অবস্থান এবং নেতানিয়াহুর জোটে তার প্রভাব এই মতামতকে একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। তবে তা এখনো ইসরায়েলের সরকারি নীতিতে পরিণত হয়নি।

সিরিয়ায় হামলার পেছনে ইসরায়েলের যুক্তি কী : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, গোলান মালভূমি সংলগ্ন সিরিয়ার যেসব অঞ্চল ১৯৭৪ সাল থেকে নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল ছিল, সেগুলো ‘চিরদিনের জন্য’ ইসরায়েলের অংশ হিসেবেই থাকবে।

বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদেন সার রোববার থেকে সিরিয়ায় চালানো হামলাকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন, সন্দেহভাজন রাসায়নিক অস্ত্রের স্থাপনা ও দূরপাল্লার রকেট উৎক্ষেপণকেন্দ্র লক্ষ্য করে তারা এসব হামলা চালিয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোয় ইসরায়েলের চলমান অভিযানের বিরোধিতাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে যেন এসব অস্ত্র না পড়ে, সে জন্যই এই হামলা চালানো হচ্ছে।

সিরিয়ায় হামলার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করছে ইসরায়েল। এর ফলে সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আন্তর্জাতিক যে সংজ্ঞা ও মান আছে, তা–ও লঙ্ঘিত হলো। ইসরায়েলের একতরফা পদক্ষেপে বাফার জোনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের উপস্থিতি আসলে অকার্যকর করে দেয়। আর সিরিয়ার বর্তমান অস্থিরতা ইসরায়েলের জন্য সুবিধাজনক, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বে উত্তেজনা বাড়তে পারে।

এমটিআই

Link copied!