রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা সহজ নয়, প্রমাণ করল ভারত

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২২, ১২:৪৯ পিএম
রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা সহজ নয়, প্রমাণ করল ভারত

নরেন্দ্র মোদী ও ভ্লাদিমির পুতিন

ঢাকা : ইউক্রেনের বিষয়ে নিজেদের পক্ষে সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে মার্চের শেষ নাগাদ ভারতে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। তবুও ভারত বিষয়টিতে এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থানে অবিচল আছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া আগ্রাসনে রাশিয়ার নিন্দা জানাতে জাতিসংঘে ভোট দেওয়া থেকেও বিরত থেকেছে দেশটি।

মার্কিন ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজর দলিপ সিং গত ৩০-৩১ মার্চ নয়া দিল্লি সফর করেন। এসময় তিনি রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো না মেনে তাদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা দেশগুলোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেন। আরো বলেন, রাশিয়া থেকে ভারতের জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি কার্যক্রমে অনুমোদন দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এর এক সপ্তাহ পর, গত ৬ এপ্রিল হোয়াইট হাউস ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের পরিচালক ব্রায়ান ডিজ ঘোষণা দেন। মস্কোর সাথে ‘আরো সুস্পষ্ট কৌশলগত জোটবদ্ধ’ হওয়ার পরিণতি ভারতের জন্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ এবং দীর্ঘমেয়াদি’ হবে।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করবে ভারত। সেইসাথে রাশিয়ার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মেনে চলবে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের এ দুটি বিষয় নিয়ে নিঃসন্দেহ ছিল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত এই শতকের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। বাইডেনও তার প্রশাসনে ভারতীয় ও ভারতের ঐতিহ্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। সেইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় সম্প্রদায়ের অবদানের গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে। কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগ বা কোয়াডের অংশ ভারত। এই জোটে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। চার দেশের এই অংশীদারিত্বের শুরু ২০০০ এর দশকে। চীনের দাপট কমানোর লক্ষ্যে একটি শিথিল রাজনৈতিক ও সুরক্ষা জোট হিসেবে কোয়াডকে

বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কোয়াড সদস্যরা ঐক্যবদ্ধভাবে সামরিক মহড়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে। এত দহরম-মহরম সম্পর্কের পরও ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটছে না ভারত। ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বজায় রাখতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়াকে নিন্দার দায় এড়ানোর সিদ্ধান্তে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। তবে ভারত এর মাধ্যমে পুরো বিশ্বকেই বুঝিয়ে দিয়েছে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা মোটেই সহজ কাজ নয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট ঘিরে ভারত সরকার নানা বিবৃতি দিয়েছে। ইউক্রেনে হামলা নিয়ে রাশিয়ার সমালোচনা করেনি নয়া দিল্লি। সেখানে আঞ্চলিক অখণ্ডতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সমস্যা হলো রাশিয়ার অস্ত্রের ওপর ভারতের ক্রমাগত নির্ভরতা। ভারত ও রাশিয়া ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৩ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

বিশ্বের অন্যতম অস্ত্র আমদানিকারক ভারত। তাই অস্ত্র উৎপাদক দেশগুলোর জন্য ভারত বেশ গুরত্বপূর্ণ। আর দেশটিতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করে রাশিয়া। একুশ শতকে ভারতের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে ব্যবসা বাণিজ্যের পরিধি। অন্যদিকে পাকিস্তান ও চীনের সাথে ঐতিহ্যগত বিরোধ নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের অস্ত্রের বাজারে রাশিয়ার আধিপত্য একটু কমেছে। তা সত্ত্বেও রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে উদগ্রীব ভারত। যে কোনো সময় মধ্য মেয়াদে রাশিয়ার সাথে আবদ্ধ হবে দেশটি। এর আভাস পাওয়া গিয়েছিল গত ডিসেম্বরে।  সেই সময় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১০ বছর মেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেন। এছাড়া রুশ সমর্থিত বৈশ্বিক ফোরাম ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে ভারত। ঐতিহাসিকভাবে মস্কোও বিভিন্ন সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভারতীয় স্বার্থের প্রচার ও সুরক্ষায় তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।

এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে বিরোধের কথা। এ বিষয়ে ভারতকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া। চীনের ওপর রাশিয়ার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে বলেও মনে করে ভারত। ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ ভারতের রাজনৈতিক মত। পুতিনের ইউক্রেন হামলায় কোনো বড় দেশেরই সমর্থন নেই; কিন্তু ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে চলছে হ্যাশট্যাগে প্রচার আই স্ট্যান্ড উইথ পুতিন।  

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জ্বালানি ব্যবসা আরো সম্প্রসাণের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত ও রাশিয়া। ২০১৭ সালে রুশ অয়েল জায়ান্ট রসনেফট ও অন্যান্য রুশ কোম্পানি ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারে কিনে নিয়েছে ভারতের এসার অয়েল নামের জ্বালানি প্রতিষ্ঠান। ভারত তার সরবরাহ লাইন বহুমুখী করার চেষ্টার অংশ হিসেবে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো রুশ তেলের বার্ষিক আমদানিতে সম্মত হয়েছিল। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর এ পর্যন্ত সময়ে রাশিয়া থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল কিনেছে ভারত। ২০২১ সালের পুরো সময়জুড়ে ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি হয়েছে। ভারতে কয়লাও রফতানি করে রাশিয়া। গত বছর রাশিয়া থেকে প্রথমবারের মতো ভারতে সরাসরি আসে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। ২০২১ সালে রাশিয়া থেকে ১৮ কোটি টন তাপীয় কয়লা আমদানি করেছে ভারত। রাশিয়া থেকে দেশটিতে প্রাকৃতিক গ্যাস এসেছে দশমিক ২ শতাংশ।

ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্র-চালিত গ্যাস অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড বছরে ২৫ লাখ টন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রুশ প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সাথে ২০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক শক্তি সংস্থা রোসাটম ভারতে তার ষষ্ঠ পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। গত জুনে শেষ হয়েছে পঞ্চম পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ কাজ।

রুশ পণ্যের প্রতি ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতার ঘেরাটোপে রাশিয়ার সাথে ভারতের জ্বালানিবিষয়ক সম্পর্কের সমালোচনা করায় পশ্চিমা বিশ্বের ভণ্ডামিরই প্রতিফলন হচ্ছে। ভারত ও রাশিয়ার ইউরো এশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। সেইসাথে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য সচল রাখতে অর্থ পরিশোধের জন্য রুপি-রুবল পদ্ধতি নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করছে ভারত সরকার।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সময় ডলারের বিনিময়ে রুপি ও রুবল ব্যবহার করে দেশ দুটি আমদানি-রফতানি চলমান রাখার পরিকল্পনা করছে। ফলে রাশিয়া থেকে ছাড়কৃত সুলভমূল্যে জ্বালানি তেলও আমদানি করতে পারবে ভারত। প্রাথমিকভাবে চলমান বাণিজ্যিক কার্যক্রমগুলোর জন্য রুপি-রুবল ব্যবহারের চিন্তা করা হলেও, বর্তমানে দুই দেশের সরকারই এভাবে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিষয়ে আরো গভীরভাবে পর্যালোচনা শুরু করেছে। রুপি-রুবল বিনিময় পদ্ধতিটি চালু হলে ভারতীয় আমদানিকারকরা ভারতে কার্যক্রম পরিচালনাকারী রুশ ব্যাংকগুলোয় রুপি ব্যবহার করে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করবে। এরপর রুশ ব্যাংকগুলো রুশ রফতানিকারকদের রুবলের মাধ্যমে দাম পরিশোধ করবে। তবে সে ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যাও আছে। রাশিয়াতে রফতানির চেয়ে বেশি আমদানি করে ভারত। ফলে রুশ ব্যাংকগুলোর কাছে রুপির পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে কমবে রুবলের বিপরীতে রুপির বিনিময় মূল্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানে ভারতকে রাশিয়ায় আরো বেশি পণ্য রফতানি করতে হবে। আমদানিনির্ভর হওয়ায় বর্তমানে রাশিয়ার সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে ভারতের। দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১  অর্থবছর (এপ্রিল’২০-মার্চ’২১)  দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৮১০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এর মধ্যে ভারত ২৬০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। আর রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে ৫৪৮ কোটি ডলারের পণ্য। এ অবস্থায় ভারত সস্তা দরে রুশ তেল কিনে পণ্য রফতানি না বাড়ালে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকবে।

ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশন (এফআইইও)  ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। প্রস্তাবে রুপি-রুবল ব্যবস্থার পাশাপাশি রুপির মাধ্যমে করা সম্ভব এমন একটি বাণিজ্যিক পদ্ধতি চালুর পরামর্শও দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় মুদ্রা রুপিতেই ব্যবসায়িক চুক্তিগুলো করা হবে এবং অন্যপক্ষ মুদ্রার বিনিময়ের হারের ঝুঁকি বহন করবে।

ভারতের বর্তমানে কৃষিযন্ত্র, ওষুধ, আসবাব, বাথরুম ফিটিংস ইত্যাদি পণ্যের নতুন বাজার প্রয়োজন। আর রাশিয়ার বাজার হতে পারে এ পণ্যগুলোর পরবর্তী গন্তব্য। আক্রমণ শুরু হওয়ার সাথে সাথে ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থীকে সরিয়ে নিতে পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে কাজ করতে হয়েছিল নরেন্দ্র মোদিকে। সংঘাতে একটি পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করার মতো বৈশ্বিক বিষয় ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে রাশিয়াও ভারতকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্কের ক্রমাগত অবনতি হওয়ায়, রাশিয়া চাইবে ভারতের মতো ক্ষমতাধর দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!