ঢাকা : ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের বিশদ বর্ণনা ওঠে এসেছে।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন অন্তত ছয়জন আর ব্যবহার করা হয়েছিল দুটি গাড়ি। হামলাকারীরা হরদীপকে লক্ষ্য করে ৫০টি গুলি ছোঁড়েন। তার মধ্যে ৩৪টি তার শরীরে বিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী ও তদন্তকারীদের দেয়া বক্তব্যে এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
গত ১৮ জুন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একটি শিখ মন্দিরের বাইরে হত্যা করা হয় হরদীপকে। স্থানীয় শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, হত্যার বিষয়ে তদন্তকারীদের কাছ হতে খুব কম তথ্য পেয়েছেন তারা। ঘটনাস্থলে পুলিশও পৌছেঁছিল দেরিতে। আর ওই মন্দির সংলগ্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও বাসিন্দাদের মত, হত্যাকাণ্ড নিয়ে বক্তব্য শুনতে বা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিতে তাদের কাছে যাননি তদন্তকারীরা।
এদিকে হরদীপ হত্যার পর গত সপ্তাহে কানাডার পার্লামেন্টে বিস্ফোরক এক মন্তব্য করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, এই হত্যায় ভারতের হাত রয়েছে, এমন ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ পেয়েছেন তিনি। গোয়েন্দা তথ্য আদান–প্রদানকারী নেটওয়ার্ক ফাইভ আইসের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই এমন অভিযোগ করেন ট্রুডো।
উল্লেখ্য, ফাইভ আইসের পাঁচ সদস্যভূক্ত দেশের মধ্যে কানাডাও অন্যতম সদস্য হিসেবে রয়েছে।
যে মন্দিরটির বাইরে ৪৫ বছর বয়সী হরদীপকে হত্যা করা হয়, সেটির সভাপতি ছিলেন তিনি। ভারতে শিখদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনের দাবিতে খালিস্তান আন্দোলনের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন হরদীপ। অন্যদিকে তার হত্যার সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে কানাডার এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে দেশটি। একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছে ভারত সরকার। যদিওবা ভারতের তালিকায় আগে থেকেই হরদীপ একজন ‘সন্ত্রাসী’।
মূলত হরদীপ হত্যার ঘটনাটি ধরা পড়েছে ওই মন্দিরে স্থাপিত একটি সিসিটিভির ফুটেজের মাধ্যমে। ৯০ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি তদন্তকারীদের দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, হরদীপের একটি ধূসর বর্ণের পিকআপ ভ্যান মন্দিরের কাছে পার্কিং থেকে বের হচ্ছে। আর এ সময় সাদা একটি গাড়িও কাছাকাছি অবস্থান করছিল। পরে সেটি হরদীপের পিকআপের পাশাপাশি চলতে শুরু করে।
পিকআপটি পার্কিং থেকে লট বেরুনোর সময় সাদা গাড়িটি সেটির গতিরোধ করে দাঁড়ায়। এ সময় দুজন পিকআপটির দিকে এগিয়ে যান। তারা মাথা ঢাকা পোশাক পরে ছিলেন। পিকআপের চালকের আসনের দিকে বন্দুক তাক করেন তারা। এরপর পার্কিং থেকে সাদা গাড়িটি বের হয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে, বন্দুকধারী দুজনও একই দিকে দৌড়ে যান।
ওই মন্দিরের এক স্বেচ্ছাসেবক ভূপেন্দরজিৎ সিং যিনি কিনা হত্যাকাণ্ডের সময় কাছেই একটি পার্কে ফুটবল খেলছিলেন। গুলির শব্দ শুনে প্রথমে আতশবাজির শব্দ বলে গা করেননি তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমার মাথায় দ্বিতীয় যে চিন্তা এসেছিল, তা হলো গুলি চালানো হয়েছে। আর আমাদের সভাপতি সেখানে রয়েছেন।’
হরদীপকে হত্যার পর প্রথম তাকে বহনকারী পিকআপের কাছে পৌঁছেন ভূপেন্দরজিৎ।
তিনি বলেন, গাড়ির কাছে গিয়েই তিনি চালকের পাশের দরজা খোলেন। আর সেখানে হরদীপ ছিলেন। তিনি তার কাঁধে হাত দেন। বুঝতে পারেন যে তিনি আর শ্বাস নিচ্ছেন না। শিখ সম্প্রদায়ের অন্য সদস্যরা বলেছেন, তদন্তকারীরা জানিয়েছেন যে হরদীপের ওপর প্রায় ৫০টি গুলি চালানো হয়েছিল, যার ৩৪টি তার শরীরে লেগেছিল।
এ সময় চারপাশে রক্ত ও ভাঙা কাচ পড়ে ছিল বলে জানান ভূপেন্দরজিৎ সিং। আর মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল গুলির খোসা । এর পরপরই গুরমিত সিং নামে মন্দিরের আরেক নেতা পিকআপ নিয়ে সেখানে আসেন। ভূপেন্দরজিৎ ওই পিকআপে করেই বন্দুকধারীদের ধরতে বেরিয়ে পড়েন।
সম্প্রতি হরদীপের পিকআপের চাকায় ট্র্যাকার খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান ব্রিটিশ কলাম্বিয়া শিখ গুরুদুয়ারা কাউন্সিলের মুখপাত্র মনিন্দর সিং।
তাদের মন্দির কমিটির আরেক সদস্য মালকিত সিং, তিনিও হরদীপকে হত্যার সময় ফুটবল খেলছিলেন। মাথা আবৃত পোশাক পরা দুজনকে কাছের কোউগার ক্রিক পার্কের দিকে দৌড়ে যেতে দেখেছিলেন তিনি। আর ওই দুজনকে তাড়া করেছিলেন মালকিত। তবে তাদের শনাক্তে ব্যর্থ হন তিনি।
মালকিত সিং বলেন, দুজনকে দেখে শিখ বলেই মনে হয়েছে তার। একজনের উচ্চতা পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি এবং স্থুলকায়। বেশি বেগে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছিল তার। আরেকজন ছিলেন প্রথমজনের চেয়ে প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা এবং রোগা–পাতলা। দৌড়ে গিয়ে তারা একটি রুপালি গাড়িতে ওঠেন। আর ওই গাড়িতে আরও তিনজন অপেক্ষা করছিলেন। অবশ্য তাদের কারও মুখমন্ডল দেখতে পাননি তিনি। এরপর গাড়িটি সেখান থেকে চলে যায়।
হত্যার ঘটনাটি তদন্ত করছে দ্য রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি)। তারা জানিয়েছে, ১৮ জুন রাত ৮টা ২৭ মিনিটে প্রথম হরদীপকে হত্যার খবর পায় পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গুলি চলার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ ১২ থেকে ২০ মিনিট পর পৌঁছায়। এটি অবাক করার বিষয়। কারণ, এই এলাকায় অনেক পুলিশ সদস্য নিয়মিত টহল দিয়ে থাকেন।
এদিকে হত্যার এক মাসের বেশি সময় পর ২১ জুলাই দুই বন্দুকধারী ব্যক্তিকে শনাক্তের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছেন তদন্তকারীরা। আর ১৬ আগস্ট রুপালি গাড়ি ও সেটির চালককে শনাক্তের বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হয়। এ ছাড়া যে পথ দিয়ে দুই বন্দুকধারী পালিয়েছিলেন, সেখানকার ৩৯ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়ি পরিদর্শন করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। তবে সেসব ব্যবসার মালিক ও বাড়ির বাসিন্দারা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ড তদন্তের বিষয়ে তাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি।
জানা যায়, হরদীপের জীবননাশের হুমকির বিষয়ে আগে থেকেই শঙ্কিত ছিল স্থানীয় শিখ সম্প্রদায়। যে মন্দিরের বাইরে তাকে হত্যা করা হয়েছে, সেটির সদস্যদের অনেকেই হরদীপের একা গাড়ি চালানোর বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
হরদীপের ছেলে বলরাজ সিং নিজ্জর বলেন, তার বাবা বুলেটপ্রুফ গাড়ি চালাতে চাইতেন। তবে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় এমন গাড়ি চালানো অবৈধ। তা ছাড়া নিরাপত্তার জন্য বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও পরতে চাইতেন তিনি। এমন জ্যাকেট ব্যবহারের জন্য সরকারের অনুমতি লাগে।
সম্প্রতি হরদীপের পিকআপের চাকায় ট্র্যাকার খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান ব্রিটিশ কলাম্বিয়া শিখ গুরুদুয়ারা কাউন্সিলের মুখপাত্র মনিন্দর সিং।
এ প্রসঙ্গে ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, হরদীপের মতো তার নামও হত্যাকারীদের তালিকাভূক্ত আছে বলে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো তাকে জানিয়েছিল। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আসেনি তার কাছে। এ তথ্য কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে কি না, সে বিষয়েও জানেন না তিনি।
বিষয়টি নিয়ে কানাডার গোয়ান্দা সংস্থা কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের এক মুখপাত্রের কাছে জানতে চাওয়া হলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্যপ্রাপ্তি নিয়ে এ ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বিষয়টি পুনরায় সামনে আনায় এখন তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে বেশ আশাবাদী মন্দির কমিটির সদস্য মালকিত সিং।
প্রতিবেদন বলছে, শিখ সম্প্রদায়ের সদস্যরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন এ কারণে যে কর্তৃপক্ষ হত্যার আগে নিজ্জারকে উপযুক্ত সুরক্ষা দেয়নি।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, হত্যাকাণ্ডের বিবরণ সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া সাক্ষীদের মধ্যে মধ্যে বেশিরভাগই নিজ্জারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তাদের দাবি, কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি।
এদিকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর, কানাডায় অবস্থিত ভারতের আখ্যা দেয়া খালিস্তানি সন্ত্রাসী হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যায় ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার অভিযোগে একজন ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কার করে ট্রুডো সরকার। অন্যদিকে কানাডিয়ান নাগরিকদের জন্য ভিসা পরিষেবা স্থগিত করেছে ভারত।
ইতিমধ্যে শিখস ফর জাস্টিস’র গুরপতবন্ত সিং পান্নুনের সম্পত্তিতে NIA অভিযান চালিয়ে পাঞ্জাবে খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানও শুরু করেছে ভারত। আর বিদেশে বসবাসরত খালিস্তানিদের ওসিআই কার্ড বাতিলেরও নির্দেশ দিয়েছে মোদী সরকার।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :