ঢাকা : বাংলাদেশে বাইডেনের ‘গণতন্ত্র ক্রুসেড’ ব্যর্থ হয়েছে বলে ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক কলামে দাবি করেছেন ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মিহির শর্মা। কলামটি প্রকাশ করেছে আমেরিকার প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট।
মিহির শর্মা লিখেছেন, অর্থনৈতিক বিবেচনায় গত এক দশকের বাংলাদেশ এক সাফল্যের গল্প। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে বাংলাদেশ গড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ক্রমাগতভাবে শীর্ষে উঠেছে। দেশটি ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ শীঘ্রই দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে ‘উত্তরণ’ করবে। বিভিন্ন বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহায়তা প্রাপ্তির আর প্রয়োজন হবে না।
রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ তেমন অনুকরণীয় নয় উল্লেখ করে ওই কলামে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পেলেও সেই নির্বাচন যথেষ্ট অবাধ ও সুষ্ঠু না হওয়া নিয়ে নানা মহলে নিন্দিত হয়েছিল।
এই মহলগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে আমেরিকার প্রসঙ্গ টানেন মিহির। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন আমেরিকা এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার একটি তালিকাও তুলে ধরেন তিনি। তিনি লিখছেন, গেল মাসে একটি অস্পষ্ট বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে , ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া’র আওতায় তারা ‘আইন প্রয়োগকারী সদস্য, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল’সহ কমপক্ষে তিনজন বাংলাদেশির ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের ‘পদক্ষেপ নিয়েছে’। বিবৃতিতে শিগগিরই এই তালিকায় অন্যান্য নাম যুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে।
ব্লুমবার্গে প্রকাশিত ওই কলামে বলা হয়, প্রকাশ্যে এভাবে ধমকানো ন্যায্য বা বিচক্ষণতার পরিচয় নয়। এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধানে পুলিশ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকীকরণ হয়েছে।
নিবন্ধটিতে বাংলাদেশের নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউসের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘আংশিকভাবে মুক্ত’ হিসেবে বর্ণনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে বলা হয়েছে, তবুও, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো ন্যায্য নয়। কারণ, দেখে মনে হচ্ছে তারা বাংলাদেশকে আলাদা করে ফেলছে। একই নিষেধাজ্ঞা তারা লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, নাইজেরিয়াসহ অন্যান্য দেশের ওপর আরোপ করেছে। অথচ সামরিক বাহিনী সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের মতো নির্বাচনে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করলেও মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট হওয়ায় সেখানে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মিহির শর্মা এই নীতিকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, বাংলাদেশের জন্য আরোপিত নীতিটি যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ এটি আমেরিকাকে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে প্রতিয়মান করছে। বাংলাদেশি রাজনীতিবিদরা ইতোমধ্যেই একে অপরকে ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে মার্কিন দূতাবাসে অভিযোগ জানাতে যায়’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। শেখ হাসিনা এই বছরের শুরুর দিকে বিবিসিকে বলেছিলেন, আমেরিকা হয়তো ‘আমাকে ক্ষমতায় চায় না।’
মিহির লিখেছেন, সম্ভবত ওয়াশিংটনের কেউ মনে করেন যে, ভারত ও তুরস্কের মতো গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণকারীদের তুলনায় বাংলাদেশের গুরুত্ব খুবই কম। বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এটি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। যেটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য অভ্যন্তরীণ লড়াই চালিয়েছে, সম্ভাব্য পরিবর্তন না ঘটলে মৌলবাদীরা ভালোভাবেই হেরে যেতে পারে।
মিহিরের মতে, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একটি ‘সুইং স্টেটও’। জ্বালানি ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগসহ বাংলাদেশকে ‘জয় করার জন্য’ চীন সময় ও অর্থ ব্যয় করেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জ্বালানি প্রকল্পের পাইপলাইন চীনা অর্থের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনকে ‘টাকার ঝুড়ি’ এবং তারা ‘আগ্রাসী ও সাশ্রয়ী মূল্যের প্রস্তাব’ নিয়ে আসছে বলে বর্ণনা করেছেন।
ওয়াশিংটনের ভুল পদক্ষেপগুলো ভারত, ফ্রান্স, জাপানের মতো আমেরিকার বন্ধু এবং মিত্রদের ভোগাতে পারে। আগস্টে, জাপান ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশ চারটি দেশের মধ্যে একটি যারা ‘সমমনা দেশগুলোর নিরাপত্তা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর’ পরিকল্পিত একটি নতুন কর্মসূচির অধীনে প্রতিরক্ষা সহায়তা পাবে।
অবকাঠামো, স্যাটেলাইট ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ গত মাসে ঢাকা সফর করেন। এদিকে চীনারা মার্কিন চাপের বিষয়ে অসন্তোষের বিষয়টিকে আনন্দের সাথে পুঁজি করে নিয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আগস্টে শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের পক্ষে ‘বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে’ প্রস্তুত।
মিহির লিখেছেন, বাংলাদেশে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কয়েক দশকের লড়াইয়ে ব্যক্তিগত বিরোধ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৬; তার প্রধান প্রতিপক্ষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ৭৮ বছর বয়সী। আমি ভাবতে চাই যে, বাংলাদেশে পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের জন্য একটি নতুন দিকনির্দেশনা তৈরির মতো গণতন্ত্রের পর্যাপ্ত শিকড় রয়েছে। তবে তা ঘটবে না, যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপকরণ হিসেবে দেখা হয়। এটি সেই ঝুঁকি যা বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গিতে চলছে, বিশেষত যদি এটি অসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা হয়।
লেখার শেষে মিহির শর্মা আমেরিকাকে বাংলাদেশ প্রশ্নে সমস্বার্থের এবং সূক্ষ্ম ও আরও নমনীয় পন্থায় এগোনোর পরামর্শ দেন। পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে পরামর্শ দেন এই বলে, আপনার অভ্যুত্থানকে সমর্থন বা কারচুপির নির্বাচনের প্রশংসা করার দরকার নেই। একই সময়ে, আপনার নিজেকে সবসময় এমন কিছুতে জড়ানো উচিত নয়, যা প্রায়শই খুব ঘরোয়া বিবাদ বলে বিবেচিত। সূত্র-ব্লুমবার্গ
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :