ঢাকা : ইসরায়েলি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে বলে সপ্তাহান্তে একটি টুইট করা হয়েছে। রবিবার মধ্যরাতের ঠিক পরে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু লিখেন, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার সতর্কতা সম্পর্কে তাকে কখনই পূর্বে অবহিত করা হয়নি। হামলায় কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ ইহুদি নিহতের জন্য নেতানিয়াহু দেশটির সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা প্রধানের ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করেন।
আর তার এমন বক্তব্যের পর শুরু হয়েছে তোলপাড়। গাজার অভ্যন্তরে যখন দেশটি একটি কঠিন সামরিক অভিযানের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে এমন সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নেতানিয়াহুর এরূপ মন্তব্যের জন্য তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। পরে পরিস্থিতি এতটাই বেসামাল হয়ে পড়ে যে প্রধানমন্ত্রী টুইটটি মুছে ফেলতে বাধ্য হন। পরে এজন্য শান্ত সুরে তার কথার জন্য ক্ষমা চেয়ে-"আমি ভুল ছিলাম" বলে একটি টুইট করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার এমন কথার জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক সংস্থার মধ্যে একটি ফাটল নিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী যা নেতানিয়াহুর নেতৃত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে নিজের দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার না দিয়ে যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেন, “তিনি শৃঙ্খলার বাইরে ছিলেন এমন কথা বলাটা এ বছরের অবমূল্যায়ন হবে।
মেকেলবার্গ বলেছেন, "এটি একটি অত্যন্ত কঠিন সামরিক অভিযান। একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুকে বিশ্বাস করেন এমন একজন ব্যক্তিও
নেই – আর এটি এই মন্ত্রিসভার প্রধান সমস্যা।"৭ অক্টোবরের পর নেতানিয়াহু বিরোধী শিবিরের কয়েকজন সাবেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি জরুরি যুদ্ধ মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গান্তেজ যিনি ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এবং শিন বেটকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার জন্য নেতানিয়াহুকে তার বিতর্কিত পোস্ট প্রত্যাহারের দ্রুত দাবি করেন।
অন্যান্য নেতাদের কাছ থেকেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর এমন অবস্থায় "
নিরাপত্তা ও জিম্মিদের প্রতি আগ্রহী নন, শুধুমাত্র রাজনীতিতে আগ্রহী," বলে মন্তব্য করেছেন বিরোধী আইন প্রণেতা আভিগডর লিবারম্যান। লিবারম্যান একসময় নেতানিয়াহুর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। অবশ্য এ নিয়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর শীর্ষ মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেন, "আমরা যুদ্ধে আছি"।এদিকে সম্প্রতি দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উত্তেজনার সর্বশেষ চিহ্ন হিসেবে যুদ্ধ মন্ত্রিসভা আর উত্তেজনাকর কথাবার্তার আদান-প্রদান বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। কারণ এই হামলা ছিল দেশের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতার অন্যতম এক পরিণতি।
যদিও দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার এমন হাল নিয়ে অনেকেই ত্রুটি স্বীকার করেছেন নেতানিয়াহু বাদে। আর এমন ঝড়োগতিতে টুইট করার আগে ইসরায়েলি এ নেতা শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে যুদ্ধ শেষ হলে সবাইকে "আমি সহ কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে"।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক পরিচালক অ্যালন লিয়েন বলেছেন, “সংঘাত শেষ হয়ে গেলে ইসরায়েলি স্থাপনাগুলোয় কী হবে তা না জানা গেলেও এটা বুঝা যায় হয়ত হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র আমরা দেখতে যাচ্ছি।”
লিয়েন বলেন, "তিনি তার যুক্তির জন্য আগেভাগেই অবস্থা প্রস্তুত করছেন।"
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে একটি অতি-জাতীয়তাবাদীর তকমা লাগানো অতি-ডানপন্থী সরকার বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস করে এরইমধ্যে বিরোধীদের সমালোচনার মুখেও পড়েছিল। কারণ গণতন্ত্রের জন্য এ সিদ্ধান্ত হুমকি হিসাবে দেখছেন সবাই। এর আগে ১০ হাজার বিক্ষোভকারী কয়েক মাস ধরে বিচারিক সংশোধনের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছেন।
৭ অক্টোবর থেকে কয়েক হাজার রিজার্ভ আর্মির সদস্য হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার জন্য অস্ত্র গ্রহণ করেছেন যা কিনা ১৯৭৩ সালে মিশর এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় সামরিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন৷
সোমবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলে, "যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের" অংশ হিসাবে সৈন্য ও সাঁজোয়া যান গাজার অভ্যন্তরে আরও গভীরে প্রবেশ করছে। এটি অবরুদ্ধ উপতক্যার ওপর তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা অব্যাহত বোমা হামলার পরের অবস্থা। আর এর আগেই অঞ্চলটিতে ৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যার মধ্যদিয়ে মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন যে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এমন ঐক্য নেতানিয়াহুর সরকারকে সমর্থনের জন্য জরুরি নয়।
জাদালিয়ার সহ-সম্পাদক এবং সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট এন্ড হিউমানিটারিয়ান স্টাডিজের অনাবাসিক ফেলো মঈন রব্বানী বলছেন, "এই সরকার ৭ অক্টোবরের আগে সমাজের মানুষের কাছে তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, আর তখন থেকেই সুরকারের জনসমর্থনের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।"
গত সপ্তাহে প্রকাশিত ইসরায়েলি ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা যায়, সরকারের প্রতি আস্থা গত ২০ বছরের মধ্যে এবারেই সর্বনিম্নে পৌঁছেছে। মাত্র ২০ শতাংশ ইসরায়েলি নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভাকে বিশ্বাস করছেন, যা জুনের তুলনায় আট শতাংশ কম।
তথাপি নেতানিয়াহু তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দিক থেকে বেশ দক্ষ বলেও পরিচিত সবার কাছে। ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী তিনি। ১৯৯৬ সালে প্রথম দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১৪ বছরের মধ্যে ১৩ বার ক্ষমতায় এসেছেন তিনি।
রাব্বানী বলেন, "তার এবং তার সরকারের আচরণের ব্যাপক বিরোধিতা রয়েছে। তবে এমন বিশ্বাস রাখা যাবে না যে নেতানিয়াহুর গভীর জনসমর্থন রয়েছে।"
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :