কী পরিবর্তন আনবেন স্টারমার?

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২৪, ০৯:৩৮ এএম
কী পরিবর্তন আনবেন স্টারমার?

জনপ্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারবেন, সেটাই স্টারমারের সামনে বড় প্রশ্ন। ছবি: রয়টার্স

ঢাকা : পরিবর্তনের ডাক দিয়ে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছে যাওয়া লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার কি তার দেশকে ‘জনআকাঙ্ক্ষর’ লক্ষ্যে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন?

যুক্তরাজ্যের মানুষ এক ধরনের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় আছে অন্তত গত তিন বছর, যা বিভিন্ন জরিপের ফলে বারবার দেখা গেছে। জনগণ কাজটি করেছে, ভোট দিয়ে তারা তাদের ‘পরিবর্তনের’ নেতাকে বেছে নিয়েছে।

বৃহস্পতিবার সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে সরকার গঠন করছে।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা হতে হয়ত তিন সপ্তাহ প্রয়োজন লাগতে পারে ৬১ বছর বয়সি কিয়ার স্ট্রারমারের। তারপর শুরু হবে প্রতিদান দেওয়ার পালা, জনগণের আস্থার প্রতিবাদন।

২০২২ সালের শেষ দিকে ঋষি সুনাক যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন অর্থনীতির নানা দিক থেকে ধুকছিল যুক্তরাজ্য। ‘দক্ষ ব্যবস্থাপক’ হয়েও জীবনযাত্রার অসহনীয় সূচকগুলো সহনসীমায় নামাতে পারেননি তিনি।

অবসান সংকট, ঘর গরম রাখার জ্বালানির উচ্চমূল্য, খাদ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যস্ফীতির বিপরীতে আয় না বাড়ার মত কঠিন পরিস্থিতিতে অভিবাসন প্রশ্নে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে বিপাকে পড়েন সুনাক।

সিএনএন লিখছে, এ অবস্থায় যুক্তরাজ্যের মানুষ একটি ‘কাঙ্ক্ষিত বিকল্প’ বেছে নিতে উদগ্রীব ছিল। সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনে তারা কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে সেই প্রত্যাশার স্পষ্ট জানান দেয়। ব্যাপক সফলতা পায় লেবার পার্টি, জনগণের চাওয়া-পাওয়া পূরণের কেন্দ্রে চলে আসেন দলটির নেতা স্টারমার।

অবশ্য সরকার পরিবর্তনের সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী হওয়া শুরু করে ২০২১ সালের শেষ দিকে। ওই বছরের নভেম্বরে এক জরিপে দেখা যায়, বিরোধীদল লেবার পার্টির চেয়ে জনসমর্থনে পিয়েছে পড়েছে কনজারভেটিভ পার্টি। ব্রেক্সিটের পর থেকে কৃচ্ছ্র আর রক্ষণশীল নীতিতে মোড়া অর্থনীতির রাজনৈতিক জুয়াই শুধু দেখেছে দেশটির মানুষ।

সিএনএনের পর্যবেক্ষণ, সেই থেকে লেবারদের প্রতি জনপ্রত্যাশার পারদ কেবল বেড়েই চলে। তার প্রতিফলন দেখা গেল ৪ জুলাইয়ের নির্বাচনের ফলাফলে।

এখন যুক্তরাজ্যের ‘দিনবদলের’ ডাক দিয়ে জনরায় পাওয়া নেতা স্টারমারকে সেই প্রত্যাশা পূরণে কাজ করার পালা।

বড় কোনো ওলটপালট না ঘটলে ঋষি সুনাক যত দ্রুত পরিবার নিয়ে বেরিয়ে যাবেন, তত দ্রুতই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বিখ্যাত ‘কালো দরজা’ দিয়ে প্রবেশ করবেন সাবেক এই মানবাধিকার আইনজীবী।

তার কাছে দেশটির জনগণের প্রথম ও প্রধান চাওয়া জীবনযাত্রা, শিক্ষা-চিকিৎসা, খাদ্যপণ্যের ব্যয় সহনশীল পর্যায়ে এনে দেওয়া।

ভোটের আগে স্টারমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের প্রতিনিধি হবেন। দেশ পরিচালনার পরিকল্পনা সংস্কার ও নতুন শিল্প কৌশল তৈরি করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবেন।

অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে নির্বাচনি ইশতেহারে একগুচ্ছ নীতি-পরিকল্পনার কথা দেশের মানুষকে শুনিয়েছেন এই লেবার নেতা। জনগণের করের টাকা দিয়ে ৭৩০ কোটি ডলারের ‘জাতীয় তহবিল’ গঠন করে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি।

সরকারি মালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানি গ্রেট ব্রিটিশ এনার্জি ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের জাতীয় গ্রিডকে কার্বনমুক্ত করতে পারবে, সেই আশার কথাও শুনিয়েছেন স্টারমার।

তিনি বলেছেন, আয়কর বৃদ্ধি না করেই এ সমস্ত অর্জন করা যেতে পারে।

লেবার পার্টির নির্বাচনি ইশতেহারে ‘পরিমিত কেন্দ্রিকতা’র সঙ্গে কিছুটা সমাজতন্ত্রেরও মিশেল দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রীয় খাতের শিক্ষায় যোগান বাড়াতে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর ওপর কর আরোপ করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের তহবিল গঠনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করার মত বিষয়।

সব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবার জন্য অপেক্ষমাণ রোগীদের তালিকা ক্রমেই ছোট করে আনা এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্টারমার।

জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা খাতে কনজারভেটিভ পার্টি বরাদ্দ প্রয়োজনমত বৃদ্ধি না করায় কোভিড মহামারীর পর থেকে ভুগছে ব্রিটেনের মানুষ।

ডানপন্থি সমালোচকরা বলছেন, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য স্টারমারকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর বাড়াতে হবে।

বামপন্থি সংশয়বাদীরা বলছেন, স্টারমারের ইশতেহারের পরিকল্পনাগুলো যুক্তরাজ্যের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট সাহসী, উচ্চাভিলাষী নয়।

যুক্তরাজ্যে গত দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আগের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সুদের হার আকাশচুম্বী, ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের মানের রেকর্ড পতন ঘটেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে সংকটে ভুগছে ব্রিটিশরা।

চিকিৎসার প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের জন্য সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের। ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য ভোট দেওয়ার পর থেকে গত আট বছর ধরে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটছেই না।

সংক্ষেপে বললে, বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থায় স্টারমারের পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হবে দুরূহ, আর তালিকাটাও দীর্ঘ।

স্টারমার পারবেন?

স্টারমারের বর্তমান পরিকল্পনাকে উচ্চাভিলাষহীন, অসৎ অথবা যুক্তরাজ্যের ঠিক যা প্রয়োজন তাই- এ ধরনের অভিধায় বাঁধা হলেও বড় কথা হল- রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত মূলধন ছাড়া নীতি প্রণয়ন অসম্ভব।

স্টারমার ২০০৮ সালে পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক (ডিপিপি) ছিলেন। তখন রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ ডমিনিক গ্রিভ ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। ওই সময়ে দেখা স্টারমারের কথা উজ্জ্বলভাবেই তুলে ধরেছেন গ্রিভ।

সিএনএনকে গ্রিভ বলেন, বাজেট কাটছাঁট করার পরেও তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে এবং কার্যকরভাবে তার বিভাগটি চালিয়েছিলেন। এটা সত্যই চমৎকার।

স্টারমার একজন দক্ষ পরিচালক হয়ে উঠেছেন, কারণ তিনি বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আটকে থাকেননি। তিনি দূরদর্শী এবং তৎক্ষণিক সমাধান দিতে পারেন।

স্টারমারের মিত্ররা তার এই তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়ার বিষয়টিকে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে দেখছেন। যদিও উভয় পক্ষের রাজনৈতিক বিরোধীরা একে তার ‘দুর্বলতা’ বলেই বর্ণনা করছেন।

ডানপন্থিদের কাছে স্টারমার এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে কোনো কিছু বলতে পারেন। তিনি এমন একজন নেতা, যিনি লেবার পার্টির সাবেক নেতা জেরেমি করবিনকে সমর্থন করেছিলেন; যে করবিন নেটোবিরোধী এবং যাকে বারবার ‘সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল’ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে; তাদের চোখে স্টারমার ব্রিটেনের জন্য একটি বিপদ।

বামপন্থিদের কাছে তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যার আমূল পরিবর্তন আনার দৃঢ় প্রত্যয় নেই। তারা মনে করেন, একবার ক্ষমতায় এলে তিনি একজন রক্ষণশীল নেতার চেয়ে ভিন্ন কিছু হবেন না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, স্টারমারের ভবিষ্যৎ সহজ নাও হতে পারে। ‘টালমাটাল’ অর্থনীতির দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সাধনের কোনো ব্ল্যাংক চেক তিনি জনগণকে দিতে পারছেন না।

এ অবস্থায় সংসদীয় ক্ষমতাকে ‘জনআকাঙ্ক্ষা’ পূরণের হাতিয়ার করতে না পারলে শেষ পর্যন্ত তাকে বেছে নিতে হতে পারে এমন কিছু, যাতে সরকার টিকবে, কিন্তু জনঅসন্তোষ কমবে না।

মধ্যপন্থি কোনো ব্যবস্থা বেছে নিতে দেখা যেতে পারে স্টারমারকে, যেখানে নিরাপত্তা তুরুপের তাস, যা গত ১৪ বছরে সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য জুয়ার মত ব্যবহার করেছে কনজারভেটিভরা।

এমটিআই

Link copied!