হানিয়া হত্যাকাণ্ড, হামাসের হাল ধরবে কে?

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২৪, ০৪:৩২ পিএম
হানিয়া হত্যাকাণ্ড, হামাসের হাল ধরবে কে?

ঢাকা : ইরানের মাটিতে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া। ইরানের রাজধানী তেহরানে নিজ বাসভবনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হত্যা করা হয়েছে তাকে। ইরানের বিপ্লবী গার্ডস বাহিনী বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসমাইল হানিয়া তার এক দেহরক্ষীসহ নিহত হয়েছেন।

২০১৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন ইসমাইল হানিয়া। তিনি হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধানের পদে থাকলেও তাঁকেই এই গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা মনে করা হত।

হানিয়ার আকস্মিক এই হত্যাকাণ্ডের পর অবাক সংগঠনটির নেতারা। প্রশ্ন উঠেছে তার অবর্তমানে হামা‌সের হাল ধর‌বেন কে? ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জন্মলগ্ন থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া স্বাধীনতাকামী এই গোষ্ঠীটির সবচেয়ে বিশিষ্ট নেতাই বা কারা?

নিজেদের সম্পর্কে বা ব্যক্তিগত কোন তথ্য জনসম্মুখে খুব কম আনেন হামাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। মূলত ইসরায়েলের হত্যা প্রচেষ্টা এড়াতেই তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয়। ইসমাইল হানিয়ার পর হামাসের সবচেয়ে বড় কয়েকজন নেতার রয়েছেন যারা সংগঠনটির হাল ধরতে পারেন।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার  : ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের অন্যতম শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গাজায় হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা এবং ইসরায়েলের অন্যতম মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি তিনি।

তিনি গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৬১ বছর বয়সী সিনওয়ার মূলত আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত। তার বাবা-মা এসেছিলেন আশকেলন থেকে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের তাদের পৈতৃক ভিটা থেকে বিতাড়িত করা হয়।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার মাজদ নামে পরিচিত হামাসের নিরাপত্তা পরিষেবার প্রতিষ্ঠাতা। এটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিচালনা করে থাকে। এই সংস্থাটি সন্দেহভাজন ইসরায়েলি এজেন্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে এবং ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা পরিষেবার কর্মকর্তাদের সন্ধান করে থাকে।

এ পর্যন্ত তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছেন সিনওয়ার। ১৯৮৮ সালে তৃতীয়বার গ্রেপ্তারের পর হামাসের এই নেতাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলেও হামাস-ইসরায়েল বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে তিনি মুক্তি পান এবং গাজায় ফিরে আসেন।

সিনওয়ার তার যৌবনের একটি বড় অংশ, ২২ বছরেরও বেশি সময় – অর্থাৎ ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি কারাগারে কাটিয়েছেন।

মুক্তির পর সিনওয়ার হামাসের বিশিষ্ট নেতা হিসাবে তার আগের অবস্থানে ফিরে আসেন এবং ২০১৭ সালে গাজা উপত্যকায় স্বাধীনতাকামী এই গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নিযুক্ত হন। অবশ্য ২০১৫ সালে সিনওয়ারকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের’ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

ইসমাইল হানিয়াহের উত্তরসূরি হিসেবে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী সিনওয়ার গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন।

মোহাম্মদ দেইফ : ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সমস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ দেইফ।

ফিলিস্তিনিদের কাছে তিনি ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে এবং ইসরায়েলিদের কাছে ‘মৃত্যুর মানুষ’ বা ‘নয়টি জীবন নিয়ে জন্মানো যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলের ফেরারী সন্ত্রাসী তালিকায় তার নাম সবার উপরে।

১৯৬৫ সালে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ দেইফ, যার আসল নাম মোহাম্মদ মাসরি। ১৯৯০-এর দশকে হামাসের সামরিক শাখা- কাসাম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি এবং ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি, যেখানে তিনি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং জীববিদ্যা অধ্যয়ন করেছেন।

১৯৮৯ সালে প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার উত্তেজনার সময় তাকে ইসরায়েল গ্রেপ্তার করে এবং ১৬ মাস আটকে রাখার পর মুক্তি দেয়। ২০০২ সালে ইসরায়েল কাসেম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা নেতা সালাহ শেহাদেহকে হত্যা করার পর সামরিক গোষ্ঠীটির প্রধান হন দেইফ। এরপর থেকেই তাকে হত্যার জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা চালায় ইসরায়েল।

দেইফকে হত্যার জন্য ইসরায়েল হন্যে হয়ে খুঁজছে। বছরের পর বছর ধরে বহু চেষ্টা চালিয়ে তাকে কোনভাবেই ধরতে পারছে না ইসরায়েল।

মারওয়ান ইসা : আল-কাসাম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ মারওয়ান ইসাআল-কাসাম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ মারওয়ান ইসা

চলতি বছরের মার্চ মাসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় আল-কাসাম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ মারওয়ান ইসা নিহতের দাবি জানানো হলেও হামাস এখন পর্যন্ত এ তথ্য নিশ্চিত করেনি। নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে একটি টানেল কমপ্লেক্সে হামলায় মারওয়ান ইসা মারা যাওয়ার দাবি জানিয়েছিল ইসরায়েল।

হামাসের শীর্ষ এই কমান্ডার ‘ছায়া মানুষ’ এবং মোহাম্মদ দেইফের ডান হাত নামেও পরিচিত। এছাড়া হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যুরোর সদস্যও তিনি।

ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছেন তিনি এবং ২০৬৬ সালে ইসরায়েল তাকে হত্যাচেষ্টা করলে আহত হন।

হামাসের সাথে তার তৎপরতার কারণে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে প্রথম ইন্তিফাদার সময় পাঁচ বছর ধরে আটক করে রাখে। এছাড়া ১৯৯৭ সালে গ্রেপ্তার হলেও ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর মুক্ত হন তিনি।

২০১১ সালে ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতের বিনিময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের অভ্যর্থনা করার সময় তোলা একটি গ্রুপ ছবির আগে তার চেহারা কারো জানা ছিল না।

ইসা ২০১২ সালের ‘শেল স্টোনস’ থেকে ২০২৩ সালের হামলা পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনায় তার ভূমিকা স্পষ্ট। গত বছর ইসরায়েলের হামাসের অনুপ্রবেশের পরিকল্পনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বলে ধারণা করা হয়।

খালেদ মেশাল : ১৯৫৬ সালে সিলওয়াদের পশ্চিম তীরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন খালেদ মেশাল।

মেশাল হামাস আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য। ১৯৯৬ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক ব্যুরোর সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিনের মৃত্যুর পর এর নেতা নিযুক্ত হন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৭ সালে মেশালকে হত্যার জন্য গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধানকে নির্দেশ দেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে বলেছিলেন।

মোসাদ এজেন্টরা জাল কানাডিয়ান পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে প্রবেশ করেছিল এবং রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মেশালকে বিষাক্ত পদার্থের ইনজেকশন দিয়েছিল। জর্ডানের কর্তৃপক্ষ এই হত্যা চেষ্টার বিষয়ে জানতে পারে এবং মোসাদের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

জর্ডানের প্রয়াত বাদশাহ হুসেইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক সরবরাহ করতে বাধ্য করায় এই হত্যা প্রচেষ্টা একটি রাজনৈতিক মাত্রা নেয়।

মেশাল ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকায় যান। রাফাহ ক্রসিংয়ে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন দল ও জাতীয় পর্যায়ের ফিলিস্তিনি নেতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং গাজা শহরে পৌঁছনো পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তার ধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল।

২০১৭ সালের ৬ মে আন্দোলনের শুরা কাউন্সিল ইসমাইল হানিয়াকে রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করে।

মাহমুদ জাহার : ১৯৪৫ সালে ফিলিস্তিনি বাবা এবং মিসরীয় মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন মাহমুদ জাহার। মিসরের ইসমাইলিয়া শহরে শৈশব কাটলেও গাজাতেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন তিনি।

জাহারকে হামাসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার ছয় মাস পর ১৯৮৮ সালে মাহমুদ জাহারকে ছয় মাস ইসরায়েলি কারাগারে রাখা হয়েছিল।

১৯৯২ সালে ইসরায়েল থেকে মারজ আল-জুহুরে নির্বাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন, যেখানে তিনি পুরো এক বছর কাটিয়েছেন।

২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের সাধারণ নির্বাচনে হামাস জয়লাভ করার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়াহের নবগঠিত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন তিনি। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিন সরকারকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন তিনি।

ইসরায়েল ২০০৩ সালে গাজা শহরের রিমাল এলাকায় জাহারের বাড়িতে এফ-১৬ বিমান থেকে অর্ধটন ওজনের একটি বোমা ফেলে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। হামলায় তিনি সামান্য আহত হলেও তার বড় ছেলে খালেদের মৃত্যু হয়।

২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি গাজার পূর্বে ইসরায়েলি অভিযানে নিহত ১৮ জনের একজন ছিলেন তার দ্বিতীয় ছেলে হোসাম। হোসাম কাসাম ব্রিগেডের সদস্যও ছিলেন। সূত্র: বিবিসি এবং ইন্টারনেট।

এমটিআই

Link copied!