ঢাকা: পারিবারিক কলহ, ভরণপোষণের অভাব এবং প্রেম-বিরহ কেন্দ্রীক ঘটনায় সারাদেশে একদিনে অন্তত ৪ জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তি ঘটনাটি ঘটেছে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায়।
প্রবাসী স্বামী টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন, তাই সন্তানের ভরণপোষণ না দিতে পেরে দুঃখে আত্মহত্যা করেছেন আখিঁ আক্তার (২২) নামের এক গৃহবধু।
এছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন স্বামী কামরুল ইসলাম (৩৫)।
বরগুনার তালতলীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন নিয়াজ মোর্শেদ নামের এক যুবক। পোস্টে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন, ‘তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া জান্নাতি মীম, শ্বশুর ফারুক গাজী, শাশুড়ি খাদিজা বেগম ও চাচা শ্বশুর মঞ্জু গাজীসহ ১০ জন আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী।’
অন্যদিকে রাজধানীর রামপুরা হাইস্কুলের পাশের একটি বাসা থেকে বর্ষা আক্তার বিথী (২৪) নামে ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। প্রেমঘটিত কারণে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছে পুলিশ।
শনিবার (৩০ নভেম্বর) এসকল আত্মহত্যার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বরগুনা:
বরগুনার তালতলীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন নিয়াজ মোর্শেদ নামের এক যুবক। সেই পোস্টে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন, ‘তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া জান্নাতি মীম, শ্বশুর ফারুক গাজী, শাশুড়ি খাদিজা বেগম ও চাচা শ্বশুর মঞ্জু গাজীসহ ১০ জন আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী।’
শনিবার (৩০ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
এর আগে ছয় বছরের দাম্পত্য জীবনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখে শুক্রবার সকালে বিষপান করেন নিয়াজ। পরে স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা।
সেখানে অবস্থার অবনতি হলে বরিশাল থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় নিয়াজকে। সেখানে তার মৃত্যু হলে আমতলীতে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার দাম্পত্য জীবনের সুদীর্ঘ লেখা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
জানা যায়, ২০১৮ সালে আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের গুরুদল গ্রামের নান্নু মোল্লার ছেলে নিয়াজের সাথে চলাভাঙ্গা গ্রামের ফারুক গাজীর মেয়ে ফারিয়া জান্নাতি মীমের বিয়ে হয়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় মীমের প্রেমিক রাকিবের সাথে ঘনিষ্ট ছবি দেখতে পায় নিয়াজ। এরপর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়।
পরে প্রেমিক রাকিব নিয়াজকে জানায়, মীমের সাথে তার আগে বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে ওই দম্পতির ঘরে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও স্ত্রী মীমকে সুপথে আনতে পারেনি বলে ফেসবুক পোস্ট দাবি করেন নিয়াজ।
ফেসবুকে নিয়াজ লিখেন, তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া জান্নাতি মীম, রাকিব, বাহাদুর, প্রিন্স রাজসহ একাধিক ছেলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়েছেন। এ সকল ঘটনা মেনে নিতে না পেরে মীমকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর তালাক দেই। তালাক নোটিশ পেয়ে ১৭ অক্টোবর স্ত্রী মীম তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই দিনই পুলিশ নিয়াজকে গ্রেপ্তার করেন।
নিয়াজের বাবা নান্নু মোল্লার অভিযোগ, আমতলী থানার ওসি আরিফ মামলার নথি না পেয়েই তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে। এ মামলায় নিয়াজ ছয় দিন জেল হাজতে ছিলেন। এছাড়া নিয়াজ ফেসবুকে লিখেন, ওসির সামনেই মীমের আত্মীয় প্রিন্স, জসিমসহ কয়েকজন তাকে মারধর করেছে, কিন্তু ওসি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
স্ত্রীর এমন পরকীয়া ও নির্যাতন সইতে না পেরে গত শুক্রবার ভোররাতে নিয়াজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ির ও তার স্বজনদের নির্যাতনের বর্ণনা স্ট্যাটাস দিয়ে বিষপান করেন। মুহুর্তের মধ্যে তার পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
এদিকে নিয়াজের মৃত্যুর খবর পেয়ে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী মীম, তার বাবা ফারুক গাজী ও তাদের স্বজনরা পলাতক রয়েছেন।
নিয়াজের বাবা নান্নু মোল্লা বলেন, আমার ছেলেকে মীম, ফারুক গাজী, খাদিজা বেগম ও মঞ্জু গাজীসহ তার স্বজনরা মানসিক নির্যাতন করে হত্যা করেছে।
তিনি আরও বলেন, মীম একাধিক পরকীয়ার জড়ালে আমার ছেলে তাকে তালাক দেয়। ওই তালাকের পর মীম আমার ছেলের বিরুদ্ধে বরগুনা নারী শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলার নথি না পেয়েই আমতলী থানার ওসি আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে। আমি এ ঘটনার সাথে জড়িত সকলে বিচার দাবি করছি।
এ বিষয়ে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া জান্নাতি মীম ও তার বাবা ফারুক গাজীর মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
নিয়াজকে নথি না পেয়ে গ্রেপ্তার এবং তার সামনে মীমের স্বজনদের মারধরের কথা অস্বীকার করে আমতলী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুল ইসলাম আরিফ বলেন, আদালতের আদেশ মতে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হস্তান্তর করা হয়েছিল। নিয়াজের মৃত্যুর ঘটনা শুনেছি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রাজধানীর রামপুরা:
রাজধানীর রামপুরা হাইস্কুলের পাশের একটি বাসা থেকে বর্ষা আক্তার বিথী (২৪) নামে এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শনিবার (৩০ নভেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে পূর্ব রামপুরা হাইস্কুল গলির ছয়তলা বাসার তিনতলা থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
বিথীর গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সি ডি খান এলাকায়। তার বাবার নাম হাবিবুর রহমান। বিথী ইডেন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স শেষ করেছেন। রামপুরায় নিজের খালার সাথে থাকতেন বিথী।
রামপুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু তারেক দিপু জানান, বিকালে খবর পেয়ে রামপুরার বাসা থেকে ওই শিক্ষার্থীর মরদহটি উদ্ধার করা হয়। পরে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়।
এসআই আরও জানান, ওই শিক্ষার্থী ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার রুম থেকে দুটি মোবাইল পাওয়া গেছে। একটি মোবাইল থেকে ফেসবুকে লাইভ চলছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রেমঘটিত কারণে সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
বিথীর মামা আব্দুল মালেক জানান, মৃত বিথী মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার সিডিখান গ্রামের হাবিবুর রহমান মুন্সির মেয়ে। বিথী ছোট থাকতেই তার বাবা মার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ছোট থেকেই রামপুরা তার খালা নাসিমা বেগমের বাসায় থাকতো। সেখানে থেকে পড়াশুনা করতো। বিথী ইডেন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্ষ শেষ করে। মাস্টার্সে ভর্তির হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল। এক ভাই একবোনের মধ্যে বিথী ছিল বড়।
তিনি আরও জানান, দুপুরে বিথী দরজা বন্ধ করে তার ঘরে ছিল। তবে অনেক্ষণ ডাকাডাকির পর দরজা না খুলায় পুলিশে খবর দেয়া হয়। পরে তারা দেখতে পায় দরজার উপরে গ্রীলের সঙ্গে রশি ঝুলছে। সঙ্গে সঙ্গে রশি কেটে দেয়া হয়। পরে পুলিশ দরজা ভেঙ্গে বিথীকে ঘরের মধ্যে পরে থাকতে দেখে। শুক্রবার থেকে সে দরজা বন্ধ করে রেখেছিল।
তিনি আরও বলেন, বিথীর বান্ধবীদের কাছ থেকে জেনেছি, একটি ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। ওই ছেলেকে সনাক্ত করতে পারলে বিস্তারিত জানা যাবে।
মানিকগঞ্জ:
বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন প্রবাসী স্বামী। এতে শিশু সন্তানকে নিয়ে জুটছিলো না নূন্যতম ভোরণপোষণ। উপরি পাওনা হিসেবে শ্বশুরবাড়িতে ছিলো শাশুড়ি, ননদ আর দেবরের স্ত্রীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। আর সেই কষ্ট সইতে না পেরে বাথরুমে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন আখিঁ আক্তার (২২) নামের এক গৃহবধূ। শনিবার (৩০ নভেম্বর) সকালে মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটেছে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার পুটাইল ইউনিয়নের ঘোস্তা বড়ইনগর এলাকায়।
নিহত আখিঁ আক্তার ওই গ্রামের সৌদি প্রবাসী জুয়েল মিয়ার স্ত্রী। তিনি ১৫ মাস বয়সি এক পুত্রসন্তানের জননী ছিলেন।
নিহতের মামা আল-আমিন খানের অভিযোগ, জীবিকার তাগিদে প্রায় দুই বছর আগে আখিঁ আক্তারের স্বামী সৌদি আরব পাড়ি জমান। এরপর থেকে আখিঁর শাশুড়ি, ননদ ও দেবরের বউ মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে আসছিল। পরে আখিঁর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে একাধিকবার মিমাংসা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
এরপর আখিঁর বাচ্চা হওয়ার পর তার স্বামী তাদের ভরণপোষণের খরচ বন্ধ করে দেয়। পরে বিষয়টি নিয়ে আখিঁ তার শাশুড়ির সঙ্গে আলোচনা করলে, তখন শাশুড়ি, ননদ ও দেবরের বউ আখিঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। শনিবার সকালে শিশু সন্তানের ভরণপোষণ ও পারিবারিক কলহের কারণে বাড়ির রাথরুমে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন আখিঁ আক্তার।
এই বিষয়ে মানিকগঞ্জ সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এস.আই) দেব দুলাল জানান, খবর পেয়ে নিহতের লাশের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় সদর থানায় একটি ইউডি মামলার প্রক্রিয়া চলছে।
ময়মনসিংহ:
ময়মনসিংহের ভালুকায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন স্বামী। শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) দিবাগত রাতে উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের পালগাঁও গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত গৃহবধূ রত্না বেগম (৩০) উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের পালগাঁও গ্রামের মুক্তার হোসেনের মেয়ে। আর তার স্বামী কামরুল ইসলাম (৩৫) বর্তা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে।
ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সামছুল হুদা খান জানান, দ্বিতীয় বাচ্চা প্রসবের জন্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্নাকে নিয়ে স্বামী কামরুল ইসলাম নিজ বাড়ি থেকে শুক্রবার দুপুরে শ্বশুরবাড়ি পালগাঁও আসেন। রাতের খাবার শেষে তাদের প্রথম সন্তানকে তার নানীর সঙ্গে রেখে স্বামী-স্ত্রী পাশের অন্য একটি ঘরে ঘুমাতে যান। রাত দশটার দিকে ছেলে কান্নাকাটি শুরু করলে নানী মনোয়ারা বেগম ওই ঘরে গিয়ে ডাকাডাকি করেন। দরজা না খোলায় সন্দেহ হয়। পরে দরজা ভেঙে ঘরের মেঝেতে রত্নার রক্তাত্ত মরদেহ ও গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় কামরুলের মরদেহ দেখতে পান। পরে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে তারা ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ দুটি উদ্ধার করে।
ওসি আরও জানান, পারিবারিক কলহের জের ধরে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্তে কাজ করছে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ দুটি উদ্ধার করে থানায় আনা হয়েছে।
এসএস/আইএ
আপনার মতামত লিখুন :