ঢাকা : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই বেরিয়ে আসছে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির খবর।
ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে রেখে দুর্নীতির ঘাট পেরিয়েছেন হাসিনা। আত্মসাৎ করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার বেশি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক তদন্ত থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প থেকে ৫৯ হাজার কোটি টাকার আত্মসাত হয়েছে। ওই আত্মসাতের সঙ্গে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের নাম উঠে আসছে। টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। স্বৈরাচার (বাংলাদেশ) শেখ হাসিনা তার আপন খালা।
টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সদস্য ও এমপি। প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন সরকারের তিনি অর্থ ও নগর বিষয়ক মন্ত্রীও। এদিকে, খালা হাসিনার সঙ্গে টিউলিপের অর্থসাৎ অভিযোগ ব্রিটেনে আলোচনার তৈরী হয়েছে। ব্রিটেনের এক সূত্রে জানা গেছে, সেখানকার সরকার বিভিন্ন মাধ্যমে (প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার) বাংলাদেশে টিউলিপের দুর্নীতির (টাকা আত্মসাত) অভিযোগ পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে, ব্রিটেনে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের কয়েকজন জানিয়েছেন, তারা লেবার পার্টির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছেন টিউলিপ সিদ্দিক কিয়ের স্টারমারের আস্থা হারাতে পারেন।
অন্যদিকে, ব্রিটেনের লেবার পার্টির সরকারের মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক, তার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাদের পরিবারে আরো কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ৪০০ কোটি ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলছে। টিউলিপ সিদ্দিক এ নিয়ে চাপের মুখে আছেন। ব্রিটেনসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো এবিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশের পর শুরু হয়েছে তোলপাড়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তিনি সরকারি প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার সঙ্গে ক্রেমলিনে গিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এনিয়ে বিরোধী রক্ষণশীলদের সরব হতে দেখা গেছে। তারা টিউলিপ সিদ্দিকের মন্ত্রী পদে থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক দলের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেছেন, বৃটেনের সর্বাধিক প্রচারিত প্রভাবশালী ট্যাবলয়েড দৈনিক, ডেইলি মেইলের প্রথম পাতাজুড়ে জায়গা করে নিয়েছেন শেখ রেহানার মেয়ে, বৃটিশ এমপি ও দেশটির জুনিয়র মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকী। রিপোর্টটিতে প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে শেখ পরিবারের এই গর্বিত উত্তরাধিকারীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা এবং খালা, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। বাংলাদেশের হাইকোর্টের আদেশে এই তদন্ত শুরু হয়। অভিযোগ রয়েছে যে টিউলিপ সিদ্দিক মোট ১০ বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক চুক্তির ‘দালালি’ করতে সহায়তা করেছিলেন। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাশিয়ার রাষ্ট্র-সমর্থিত কোম্পানি রোসাটম দ্বারা নির্মিত হয়। ২০১৩ সালে শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন টিউলিপ সিদ্দিকের উপস্থিতিতে ক্রেমলিনে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই সময় টিউলিপ ছিলেন বৃটেনের লেবার দলের একজন কাউন্সিলর।
তারা আরো বলেন, বিশাল এই দুর্নীতির তদন্ত শুরু করার জন্য আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা, চাচাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম (শেখ সেলিম), ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ভাগিনী টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও ভাগিনা রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ শেখ পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য এবং আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যাযের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিউলিপের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের সংসদ সদস্য জো রবার্টসন। তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার যে, জটিল কিছু প্রশ্ন উঠেছে-যেগুলোর জবাব প্রয়োজন। আসলে ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রীর (টিউলিপ) সম্পর্ক কোথায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোগ নিয়ে টিউলিপ পদে থাকতে পারেন কিনা-এমন প্রশ্নও তোলেন ওই রাজনীতিক। টিউলিপের বিরুদ্ধে অভিযোগ ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটির মধ্যেও ব্যাপক আলোচনা তৈরী হয়েছে।
টিউলিপ সিদ্দিক ২০১৫ সালে উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেইট আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, যে আসনটি প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের আসন হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের লাগোয়া। আদালতে দাখিল করা দলিল থেকে বিবিসি জানতে পেরেছে, ববি হাজ্জাজ অভিযোগ করেছেন যে ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের রুপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে টিউলিপ সিদ্দিক রাশিয়ার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বৈঠকের মধ্যস্থতা ও সমন্বয় করেছিলেন।
দলিলগুলোর বরাত দিয়ে অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, এসব আলোচনার ফলে প্রকল্পের ব্যয় অন্তত ১ বিলিয়ন পাউন্ড বাড়ানো হয় যার ৩০ শতাংশ টিউলিপ ও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্টন করা হয়। বিভিন্ন ব্যাংক ও বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে এই টাকা পৌঁছানো হয় তাদের কাছে। ববি হাজ্জাজের অভিযোগ অনুযায়ী, এই প্রকল্প থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন (৩৯০ কোটি) পাউন্ড সরিয়ে নেয় পতিত শেখ হাসিনার পরিবার ও তার মন্ত্রীরা।
দুর্নীতি দমনের মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে হতভম্ব যুক্তরাজ্য। সব মিলিয়ে টিউলিপকে নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে। ডেইলি মেইলে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুলাইতে সিটি মিনিস্টার হওয়ার পর থেকে আরও কয়েকটি বিষয়ে বিতর্কিত হয়েছেন টিউলিপ। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের বিধান ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগে বলা হয়, প্রায় ১৪ মাস ধরে বাসা ভাড়া থেকে আসা আয়ের কথা গোপন রেখেছেন তিনি।
বিধান অনুসারে, ২৮ দিনের মধ্যে এসব আয়ের কথা প্রকাশ করতে হয়। এ নিয়ে তদন্ত হওয়ার পর ঘটনা সত্য প্রমাণিত হওয়ায় ক্ষমা চান টিউলিপ। অনিচ্ছাকৃত ভুল ধরে নিয়ে সেবারের মতো তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপর আগস্টে সংবাদমাধ্যম ‘দ্য মেইল অন সানডে’র এক প্রতিবেদনের জেরে আবারও বিতর্কিত হন টিউলিপ। প্রতিবেদনে জানানো হয়, দুই বছর আগে ২ মিলিয়ন পাউন্ডের যে বিলাসবহুল বাড়ি টিউলিপ ভাড়া করেন, সেটি মূলত তার খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক রাজনৈতিক সহযোগীর।
ডেইলি মেইল আরো জানায়, অতীতে বিভিন্ন সময়ে খালা শেখ হাসিনাকে ‘রোল মডেল’ বলে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন টিউলিপ। তবে আগস্টে উৎখাত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত খালাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। তবে, খালার কট্টর রাজনৈতিক দলের সাথে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সংশ্লিষ্ট টিউলিপ। একসময় তিনি আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন।
জুলাই-আগস্টে বৈষম্যেবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে’ জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার (মামলার প্রধান আসামি) বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ওই আন্দোলনে শত শত আন্দোলনকারী নিহত হয়েছে। গুরুতর আহতরা এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের অনেকেই পঙ্গুত্ব হয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়েছেন দলটির সভাপতি স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা।
এখন তিনি আশ্রয়ে দিল্লিতে আছেন। গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারে মন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি, দোসরসহ দলটির নেতারা আছেন আত্মগোপনে। হত্যাসহ অন্য মামলায় অনেকেই গ্রেপ্তার, কারাগারে আছেন। তবে, শেখ পরিবারের কোন সদস্যর গ্রেপ্তারের তথ্য পাওয়া যায়নি। তথ্যমতে, ওই পরিবারের সকল সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।পাশাপাশি, আওয়ামী লীগের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
টিউলিপের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতির যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা ‘পুরোপুরি অসত্য’ এবং ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। তবে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্রের তথ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে এ ইস্যুতে কথা হয়েছে টিউলিপি সিদ্দিকের এবং দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতে জড়িত থাকার যে অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে, সেসবের সঙ্গে সে সবে তার ‘কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা’ নাকচ করেছেন টিউলিপ।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :