ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতারণার শঙ্কা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২০, ০১:১২ পিএম
ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতারণার শঙ্কা

ঢাকা : করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভ্যাকসিন নিয়ে গোটা বিশ্বে অপেক্ষা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। এরই মাঝে নকলবাজরা ভ্যাকসিনকে টার্গেট করতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। সংস্থাটির আশঙ্কা বাজারে নকল টিকা বিক্রির চেষ্টা হতে পারে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, তাদের ১৯৪টি সদস্য রাষ্ট্রের জন্য বৈশ্বিক সতর্কতা (গ্লোবাল অ্যালার্ট) জারি করেছে এবং অপরাধীচক্র যাতে সরাসরি বা অনলাইনে কোভিড ১৯-এর ভুয়া টিকা বিক্রি করতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে বলেছে।

একই রকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, যখন এটা প্রাইভেট সেক্টরে যাবে তখনই নকল হতে পারে। তাই বেসরকারি ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন দেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হলে সেখানে সরকারি নজরদারি প্রখর করতে হবে।

কারা কতটুকু ভ্যাকসিন আনছে, কীভাবে সেগুলোর ডিস্ট্রিবিউশন হচ্ছে, তা নিয়ে জোরালো নজরদারি থাকতে হবে। প্রতারণা রোধে প্রথমত, সরকারকেই ভ্যাকসিনের দায়িত্ব নিতে হবে।

ইতোমধ্যে গত ২ ডিসেম্বর মার্কিন ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেক উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা সর্বসাধারণের জন্য অনুমোদন পেয়েছে।

ফাইজার ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না জানিয়েছে, তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনও চূড়ান্ত পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাকসিনটিও ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর।

ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন-বিষয়ক জাতীয় পরিকল্পনার কাজ প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। এখন কেবল মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অপেক্ষা।

এদিকে খুব তাড়াতাড়িই বাংলাদেশ করোনার ভ্যাকসিন পাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা তার আগেও আসতে পারে।

গত ৫ নভেম্বর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের তিন কোটি ডোজ সংগ্রহের জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় সরকারের। এর জন্য সরকারের ব্যয় হবে এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ভ্যাকসিন কেনা থেকে শুরু করে মানুষের শরীরে দেওয়া পর্যন্ত এই টাকা খরচ হবে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রায় ৭৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ছাড় করেছে।

গত ৩০ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, অক্সফোর্ড থেকে তিন কোটি টিকা কিনবে বাংলাদেশ।

প্রথম দফায় এসব টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালা অনুযায়ী জনগণের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। করোনাভাইরাসের টিকা এলে সেটা পর্যায়ক্রমে সবাই পাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রির ইতিহাসে যা হয়েছে, ভ্যাকসিন বিক্রির ইতিহাসে যে সেটা হবে না, তা নয়। তবে একই সঙ্গে কেবলমাত্র সরকারি সামর্থ্য দিয়ে ভ্যাকসিন আনার যে উদ্যোগ সেটা সম্ভবত যথেষ্ট হবে না। এখানে প্রাইভেট সেক্টরের সহায়তা লাগতেই পারে।

কিন্তু সেখানে খুব সুনিয়ন্ত্রিত, সুপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাদের নিবন্ধন রয়েছে, যাদের সরকার জবাবদিহিতায় আনতে পারবে তাদেরই সুযোগ দিতে হবে। সরকারের জোর নজরদারির দরকার হবে। কোনোভাবেই ব্যতিক্রম হলে চলবে না, বলেন অধ্যাপক লিয়াকত আলী।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ভুয়া ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতারণা করার বড় আশঙ্কা আছে।’ এমন মন্তব্য করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যে দেশে করোনার নকল টেস্টের নকল সনদ দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতারণা হতেই পারে।’

তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে ছোটখাটো ক্লিনিক, অনিবন্ধিত হাসপাতালগুলোই নকল ভ্যাকসিন বিক্রি করতে পারে। সাধারণ মানুষের আসল-নকল ভ্যাকসিন চেনার ক্ষমতা নেই। তাই নির্দিষ্ট কতগুলো সেন্টার থাকা উচিত যেখান থেকে মানুষ ভ্যাকসিন পাবে।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বিএমএ’র (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, নিশ্চয়ই প্রাইভেট সেক্টরে দেওয়া হলে নকল ভ্যাকসিন ঢুকে পড়বে। এটা একটা বড় ব্যবসাও বটে। লাভ যেখানে থাকবে, সেখানে নকলের আশঙ্কা তো আছেই।

তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কয়েকদিনের মধ্যে আমরা একটি পদক্ষেপ নেব। সরকারকে অ্যালার্ট করতে চাই আমরা। আমার মনে হচ্ছে, পাবলিক সেক্টরে এর সম্ভাবনা কম। প্রাইভেট সেক্টরে কারসাজি হবেই।’

ভ্যাকসিন নিয়ে প্রতারিত হওয়ার বা দেশে নকল ভ্যাকসিন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব আব্দুল মান্নান বলেন, আমাদের দেশে নকল ওষুধ বানানোর বুদ্ধি রয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও তা নেই। কাজেই এখানে যেহেতু সব নকল হয়, এটাও হবে হয়তো।

ভ্যাকসিন নকল হলে সরকারের পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ভ্যাকসিনের চুক্তি করছি। টাকাপয়সা দিচ্ছি, যোগাযোগ রাখছি। ভ্যাকসিন আসতে আরো দুই-তিন মাস লাগবে। আজ যদি দেখতাম যে বাজারে নকল ভ্যাকসিন এসে গেছে, তবে একটা কথা ছিল। আগেই নকলের চিন্তা বেশি করছি আমরা।’

স্বাস্থ্যসচিব আরো বলেন, ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর মোবাইল কোর্ট করছে। যদি ভ্যাকসিন নকল হয়ে যায়, সেটা নিয়ে সরকার কতটা অ্যাকশনে যাবে তা বোঝার বাকি থাকে না। ভ্যাকসিনের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। অনেক প্রটোকল আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাও আছে। দেশে খুবই কড়াকড়ির মধ্যে এটা বিতরণ হবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!