ঢাকা : গত দুই সপ্তাহ ধরেই করোনা সংক্রমণের হার নিম্নমুখী। টানা ২৯ দিন কঠোর বিধিনিষেধের পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে করোনা রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার ফের বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। এমনকি শুরু হতে পারে তৃতীয় ঢেউও।
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াত নিশ্চিত করতে ‘মুভমেন্ট পাস’ চালু করে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২২ দিনে মুভমেন্ট পাস ওয়েবসাইটে ঢোকা হয়েছে ২২ কোটি ৫৬ লাখ ৯৮ হাজার ১১৪ বার। মুভমেন্ট পাসের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৩২০টি। তাদের মধ্যে ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩২ জনকে এ পাস ইস্যু করা হয়েছে।
গত মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। সংক্রমণ এবং মৃত্যু ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ ঘোষণা দেওয়া হয়। যা চলবে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত।
এই লকডাউনের সুফল মিলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, খুশির খবর হলো ধীরে ধীরে আমরা লকডাউনের সফলতা পাচ্ছি। আমাদের এখানে প্রতিদিন করোনা রোগীর সংখ্যা কমছে। এক সপ্তাহ আগে যে করোনা রোগীর চাপ ছিল সেটা আর এখন নেই। আমাদের আছে ৩০০ বেডের করোনা ইউনিট। রোগীর সংখ্যা কমে আজ মাত্র ১১৪ জন করোনা রোগী ভর্তি আছেন। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১২ জন করোনা রোগী ভর্তি হয়েছেন।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মনোয়ার হোসেন খান বলেন, সরকারের দেওয়া সর্বাত্মক লকডাউন ও পুলিশের মুভমেন্ট পাসের কারণে সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। লকডাউন শুরুর পর থেকেই সড়কের মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোস্টে আসা মাত্রই জনগণকে জিজ্ঞাসা করেছে। এতে করে মানুষ কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছে। সে কারণে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া মানুষ আগের তুলনায় স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্ক ব্যবহারে সচেতন হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক-এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্যই চলাচল নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কঠোর হতে হয়েছে। নিয়মিত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে সারা দিন পথে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে পুলিশ। খেটে খাওয়া মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে। তাই কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুভমেন্ট পাস প্রচলনের ফলে মানুষের চলাচল অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। করোনার ভয়ংকর সংক্রমণ রোধে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, করোনা সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছিল তাতে লকডাউন না থাকলে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারে গিয়ে দাঁড়াত এবং মৃত্যুর হারও বেশি হতো। এবারের লকডাউনে পুলিশের পক্ষ থেকে খুব কড়াকড়ি ছিল। এই কড়াকড়িতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ব্যাংক, শিল্পকারখানা, আইনজীবীসহ আরো কিছু পেশার মানুষ লকডাউনের আওতামুক্ত ছিল। প্রথম দিকে যারা বের হয়েছেন তারা নিজেদের গাড়ি নিয়েই বের হয়েছিলেন তাদেরকে আমরা প্রতি চেকপোস্টে চেক করেছি এবং তারা জরুরি কাজে নির্ধারিত ডকুমেন্ট নিয়েই বের হয়েছিলেন। তাদের ওপর আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, আর যাদের কোনো পরিচয়পত্র ছিল না তারা মুভমেন্ট পাস নিয়ে বের হয়েছিল। যারা পাস দেখাতে পেরেছিলেন তাদেরকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি। এর বাইরে যারা কারণ ছাড়াই বের হয়েছিলেন তাদেরকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। এই কড়াকড়ি থাকার কারণেই আজকে করোনা সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছে। এটা লকডাউনের ফলাফল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, লকডাউন যত শিথিল হয়েছে মানুষ তত বাইরে বের হয়েছে আর তত বেশি মিক্সিং বেড়েছে। এর ফলে কিছুদিন পর আবার করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যেতে পারে। যত কড়াকড়ি বাস্তবায়ন হবে তত কম মানুষ আক্রান্ত হবে। তবে মানুষের চাহিদা, অর্থনীতি, জীবনচক্রসহ সবকিছুকে মিলিয়ে সরকার যতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সবগুলোই যথাযথ হয়েছে। তবে লকডাউন বাস্তবায়ন করার একচ্ছত্র দাবিদার পুলিশ। সরকারের নীতিমালায় পুলিশ মাঠে থেকে কাজ করেছে। যখন যে নির্দেশনা এসেছে পুলিশ ঠিক সেভাবেই বাস্তবায়ন করেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, লকডাউনের শুরু থেকেই মহাপরিদর্শকের নির্দেশনায় এবং তার উদ্যোগে মুভমেন্ট পাস ছাড়া কেউ বেরোবে না এটা শক্তভাবেই আমরা মাঠে প্রতিপালন করার চেষ্টা করেছি। এর পরেও মানুষ নানা কারণে বের হয়েছে। আমরা তাদেরকে সচেতন করার জন্য মাঠে থেকে কাজ করেছি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে ও মাস্ক ব্যবহার করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এখন মার্কেট-শপিংমল খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে ৯৯ শতাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছে। আগের চেয়ে মানুষ নিজেরাও সচেতন হয়েছে। পুলিশের কড়াকড়ি ছিল পাশাপাশি সব বয়সি মানুষ নিজেরাও বিপদ বুঝতে পেরে সচেতন হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি মানুষের অবদানকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এই দুটি প্রচেষ্টার ফলেই ধীরে ধীরে করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের কথা জানায় সরকার। গত বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর থেকে শনাক্তের হার কমতে শুরু করে।
গত বছরের জুন থেকে আগস্ট, এই তিন মাসে করোনার সংক্রমণ ছিল তীব্র। মাঝে নভেম্বর-ডিসেম্বরে কিছুটা বাড়লেও বাকি সময় সংক্রমণ নিম্নমুখী ছিল। চলতি বছরের মার্চে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণ বেশি তীব্র। মধ্যে কয়েক মাস ধরে শনাক্তের চেয়ে সুস্থ বেশি হওয়ায় দেশে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমে আসছিল। কিন্তু মার্চ থেকে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যাও আবার বাড়তে শুরু করে। এ অবস্থায় আবারো লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :