অধিকাংশ কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ, চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ

হযবরল গণটিকা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২১, ১২:০০ পিএম
হযবরল গণটিকা

ঢাকা : নানা নাটকীয়তার পর বাংলাদেশে শনিবার  (৭ আগস্ট) থেকে গণটিকাদান বা ‘ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন' শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনার জন্য প্রথমে ছয় দিন ধরে এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে পরে টিকার স্বল্পতার সেই সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়।

শনিবার (৭ আগস্ট) করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে ছয় দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকাদানের আওতায় আনার পরীক্ষামূলক এ কার্যক্রমে অংশ নিতে দেশজুড়ে টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সরকার প্রথমে রেজিস্ট্রেশন করে টিকা দেয়ার নিয়ম চালু করলেও এবার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়েই টিকা নিতে পারছে মানুষ।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, টিকা গ্রহীতাদের কাছ থেকে পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখা হচ্ছে যেগুলো তারা নিজেরাই পরে মূল ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করে দেবেন। ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকা গ্রহীতারা স্বাস্থ্য বিভাগের টিকা সম্পর্কিত এসএমএস পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভিড়ের কারণে ঢাকাসহ নানা জায়গায় অনেক কেন্দ্রেই চরম অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হতে দেখা গেছে।

টিকা গ্রহীতা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যা বলছেন : ঢাকার মহাখালীতে টিকা দিতে বয়স্ক মাকে নিয়ে আসা ৪৪ বছর বয়সী বেসরকারি চাকরিজীবী নাসিরুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘চরম হযবরল অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নাই। ভিড় আর হুড়োহুড়ির কারণে এক ঘণ্টা মাকে বাইরে গাড়িতে বসিয়ে রাখার পর টিকা দিতে পেরেছি। প্রায় একই অবস্থা ঢাকার বাইরের অনেক জায়গাতেই।

রাজশাহীর তানোরে তালন্দ ইউনিয়নের নারায়ণপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের দিক থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে অনেক কিন্তু অনেকেই এক সাথে কেন্দ্রে আসায় ভিড় বেশি হয়েছে।

আবার স্বরূপকাঠির সাংবাদিক আসাদুজ্জামান আসাদ বলছেন, তিনি সেখানকার কয়েকটি ইউনিয়নের টিকাদান কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেছেন। মানুষের মধ্যে আগ্রহ-উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষও তৎপর কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না কেউ। আবার বৃষ্টির কারণেও অনেক জায়গায় সমস্যা হয়েছে।

স্বরূপকাঠির বলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ডের আঞ্জুমান আরা বলছেন, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা নির্বিঘ্নে টিকা দিয়েছেন। ‘মেম্বারের কাছ থেকে শুনে ইউনিয়ন কেন্দ্রে এসে অল্প সময়ের মধ্যেই টিকা নিলাম। লাইন বড় ছিল না, তাই সময় কম লাগছে। এখন বাড়ি যাচ্ছি,’ বেলা একটার দিকে ফোনে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

সারা দেশে থেকে আজ শুরু হওয়া টিকাদান ক্যাম্পেইনে ২৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পঞ্চাশের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী, নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়ার কার্যক্রম নিয়েছে সরকার।

সরকার বলছে, এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সারাদেশে ৪ হাজার ৬০০টি ইউনিয়নে, এক হাজার ৫৪টি পৌরসভায় ও সিটি করপোরেশনের ৪৩৩টি ওয়ার্ডে টিকাদান কর্মসূচি চালানো হবে। সরকার প্রাথমিকভাবে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের টিকা দেয়ার বিষয়ে চিন্তা করলেও পরে সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭ ফেব্রæয়ারিতে টিকা কার্যক্রম শুরুর পর এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসের প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছে আর দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন হয়েছে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের।

তবে গত কিছুদিন ধরে ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে চুক্তি অনুযায়ী টিকা না আসায় টিকাদান কার্যক্রমে শুরুর গতি ধরে রাখা যায়নি। পরে চীন থেকে টিকা কেনার পাশাপাশি কোভ্যাক্স থেকেও টিকা আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার ও সিনোফার্মের টিকা দেয়া হচ্ছে।

এক মিনিটে ২ হাতে ২ টিকা : রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের পাটকিয়াবাড়ী দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রে শনিবার সকালে এক গৃহবধুকে এক মিনিটের ব্যবধানে দুটি টিকা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। গৃহবধুর নাম ইসমত আরা (৩১)। তিনি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের বিলটাকাপোড়া গ্রামের বাসিন্দা জেলা কৃষকলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য নাহিদুল হক স্বপনের স্ত্রী।

নাহিদুল হক স্বপন অভিযোগ করেন, পাটকিয়াবাড়ী দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রে আমার স্ত্রী ইসমত আরা করোনার টিকা নিতে গেলে একটি টিকা নেয়ার পর ধরে বসে রয়েছে এমন সময় এক মিনিটের ব্যবধানে আরেকটি হাতে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই টিকা পুশ করেছে। এতে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তবে এখনো সুস্থ রয়েছে।

তিনি বলেন, বিষয়টি সিভিল সার্জনসহ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, তারা আশ্বস্ত করেছে আমরা সব সময় তদারকিতে রাখবো। এ কারণে বালিয়াকান্দি হাসপাতালে নিয়ে রাখা হয়েছে। রাজবাড়ী সিভিল সার্জন ডাঃ ইব্রাহিম টিটন বলেন, আমরা বিষয়টি শুনে তাৎক্ষণিকভাবে ওই বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। তিনি এখনো পর্যন্ত সুস্থ আছেন। তাকে হাসপাতালে রাখা হবে।

শেখের ব্যাটিরে ধন্যবাদ : বাপ-দাদাগো কাছে অনেক মহামারির কথা শুনছি। তয় এই জনমে নিজের চোখে করোনার মহামারি দেখলাম। শুনছি টিকা নিলে ভালো থাকন যাইবো। সবাই শহরে যাইয়া টিকো নেয় শুনছি। আমরা গ্রামে থাকনে টিকা নিবার পারি নাই। ক্যামনে শহরে যাইয়া টিকা নিমু, তা জানতাম না। আজকে ইউনিয়নে টিকা নিবার পাইরা ভালো লাগতেছে। এতো সহজে টিকা পামু ভাবি নাই, শেখের ব্যাটিরে ধন্যবাদ।

মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদে তেঘুরী এলাকার সুরভী বেগম (৫৫) টিকা নিতে এসে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এভাবেই এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন।

শনিবার (৭ আগস্ট) সকাল ৯টার দিকে গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদে উপেজলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন এ ইউনিয়নের টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। এ সময় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. লুৎফর রহমান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন সরকার উপস্থিত ছিলেন।

সুরভী বেগমের মতো রোকেয়া বেগম (৫০) বলেন, ‘আমরা গ্রামের মানুষ। আমাগো প্রতিদিন কাম কাজ কইরা খাওন লাগে। শহরে গিয়া টিকা নিবার গেলে সারাদিন লাইগ্যা যাইতো। এখন তো বাড়ির কাছ থ্যাইয়া টিকা নিলাম। বাড়ি গিয়া বাকি কাম কাজ করবার পারুম।

ঘোনা শ্রীরাম বাড়ি এলাকার ৭৭ বছর বয়সী সলীম দেয়ান বলেন, বয়সের ভারে ঠিকমতো চলবার পারিনা। টিকাকেন্দ্র কাছে হওয়াতে আসবার পারছি। আসার পর ভোটার আইডি কার্ড দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকা নিবার পারছি। কোনো ঝামেলা নাই।

গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন সরকার বলেন, ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি সফল করার চেষ্টা করছি। সকালের দিকে বৃষ্টি হলেও সাধারণ মানুষের আগ্রহের কোন কমতি নেই।

সিভিল সার্জন ডা. আনোয়ারুল আমিন আখন্দ জানান, সারাদেশের মতো মানিকগঞ্জের ৬৫টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় সকাল ৯টা থেকে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ৩টি করে টিম কাজ করছে। প্রতিটি টিমে ২ জন টিকাদান স্বাস্থ্যকর্মী ও ৩ জন করে স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। প্রতিটি টিম দুইশো করে টিকা দিতে পারবে। সেই হিসেবে প্রতিটি ইউনিয়নে ছয়শো করে লোক টিকা গ্রহণের সুযোগ পাবেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!