ঢাকা : ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধ এক ভিন্ন মাত্রা পেতে শুরু করে। বর্ষা, শরত আর হেমন্ত পেরিয়ে শুরু হয় শীতের মৌসুম। গ্রাম-বাংলাজুড়ে শীত নামে। কিন্তু শীত নেই মুক্তিকামী বীর বাঙালির। হানাদারবাহিনীকে পরাজিত করতে দেহের রক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটছে।
এই যখন অবস্থা তখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখিতপত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন বৈঠকের পর বৈঠক করছে। সবাই যখন চরম উদ্বেগ আর চিন্তার মধ্যে ছিলেন তখন এলো খুশির সংবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রদানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ভেস্তে যায়। পোল্যান্ডও এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের এ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা। প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র যখন হেরে গিয়েছিল তখন পক্ষান্তরে পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
এদিনে বাংলাদেশের সকল রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকায় হানাদার বাহিনী সর্বত্র পিছু হটছিল। পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ক্রমশ পঙ্গু হয়ে পড়ছিল। সীমান্ত শহর দর্শনা সম্মিলিত বাহিনীর দখলে চলে আসে।
এদিকে ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে। ঢাকা-চট্টগ্রাম-করাচি-শত্রæ ঘাঁটিতে চলে বোমাবর্ষণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশে চলে জোর বিমান যুদ্ধ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য এদিনটি ছিল অস্থির আর উদ্বেগের।
পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দাবি করে যে, ‘এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।’
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আজ জোর দিয়ে বলেন, এই যুদ্ধ ভারতের সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধ হবে। জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন, পাকিস্তানের বন্ধুরা তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তবে তিনি কোনও দেশের নাম বলেন নি।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উর্দুতে বলেন, আমরা আমাদের সন্মানের জন্য লড়াই করছি। আমাদের বিশেষ এই কাজে ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন।’
যৌথ বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এবং ১ নম্বর সেক্টর ক্যাপ্টেন মাহফুজ পশ্চিমাঞ্চল থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে পূর্বাঞ্চলের দিকে এগুতে থাকেন। তারা পাকিস্তানিদের বিভ্রান্ত করতে সম্মুখভাগের ক্যাম্পগুলোর পাশ ঘেঁষে অতিক্রম করেন।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো বিভিন্ন পাকিস্তানি সামরিক ঘাটিতে বোমা হামলা চালায়। ঢাকা ছিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর মূল ঘাঁটি।পাকিস্তানিদের বেশিরভাগ যুদ্ধবিমানগুলো ঢাকাতে ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মিগগুলোকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে আদেশ করেন, কিন্তু অধিকাংশ স্যাবর ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রেসিডন্ট ইয়াহিয়া বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, পাকিস্তান যথেষ্ট সহ্য করেছে। আর নয়। পাকিস্তানিরা ‘পাকিস্তানের মাটিতে’ ভারতীয় বাহিনীকে শুধু আক্রমণ করবে না বরং ভারতের সীমান্তেও আঘাত করবে।
১৯৭১-এর এদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সঙ্গে রয়েছে ভারতীয় মিত্র বাহিনী। মুক্তি ও মিত্রবাহিনী চারদিক দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে। একের পর এক শত্রæঘাঁটির পতন ঘটিয়ে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে মুক্তাঞ্চলগুলোতে সমবেত হতে শুরু করেন।
এদিন যুক্তরাষ্ট্র যখন হেরে গিয়েছিল তখন পক্ষান্তরে পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া তৎকালীন পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিলেন উত্তরে চীন ও দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের জন্য সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে নি। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে-
১. পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে,
২. উত্তরাঞ্চল থেকে দু’ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে,
৩. পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে, এবং
৪. মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আরেকটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে। যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারাদেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে শুরু করে।
ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকায় জোর বিমান যুদ্ধ চলে। ঢাকা ছিল পাক বিমানবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি।
এ সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি তৎকালীন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবুল আলা মওদুদী পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানকে জানান, ‘প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে লক্ষ্মীপুর হানাদার মুক্ত হয়। যুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনায় লক্ষ্মীপুর ছিল বিপর্যস্ত।
৩নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শমশেরনগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেলস্টেশন দখল করেন। ৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন মেহেরপুর। এছাড়া ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে কামালপুর নিজেদের আয়ত্তে আনেন।
এছাড়া এ দিন অদম্য মুক্তিসেনারা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, দামুড়হুদা, জীবননগর, বকশীগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকা দখলমুক্ত করেন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :