ঢাকা : আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কারণ বীর সন্তানদের মনোবল ভেঙে দেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়।
১৯৭১ এর এদিন গভর্নর এ এম মালেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একটি বস্তুনিষ্ঠ বার্তা পাঠান। এটি বেতারবার্তা।
টু দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান : সামরিক পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। শত্রæরা পশ্চিমে ফরিদপুরের দিকে এগোচ্ছে। শত্রæরা কুমিল্লা ও লাকসামে আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে পূর্বদিক দিয়ে মেঘনা নদী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সব নদীপথ রুদ্ধ করে তারা চাঁদপুর দখল করে নিয়েছে। বাইরের কোনো সাহায্য যদি অবিলম্বে আমাদের কাছে না পৌঁছে, তাহলে শত্রæরা যেকোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছাবে।
ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি বেসামরিক জনগণ বিশেষ করে অবাঙালিদের জীবন রক্ষা করার জন্য ঢাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি এ প্রস্তাব গ্রহণ করার পক্ষে। এ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য আমি জোর সুপারিশ করছি।
প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো দীর্ঘ বেতারবার্তায় গভর্নর আরও বলেন: জেনারেল নিয়াজি এই প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, এ ক্ষেত্রে তার আদেশ হবে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া। তার মানেই ঢাকার পতন।
নিয়াজির পথে এগোলে সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ডে শিকার হবে। তাদের সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের আরও শিকার হবে পশ্চিম পাকিস্তানি পুলিশ, অবাঙালি নাগরিক এবং (পাকিস্তানের প্রতি) অনুগত স্থানীয় জনগণ। আমাদের রিজার্ভে কোনো নিয়মিত বাহিনী নেই।
শত্রুরা একবার গঙ্গা (পদ্মা) বা মেঘনা পাড়ি দিয়ে চলে এলে যদি আজকের মধ্যেই চীন কিংবা আমেরিকা নৌ ও আকাশপথে আমাদের সহায়তা না দেয়, তাহলে প্রতিরোধের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি অনুমোদনের এবং রাজনৈতিক সমাধানের সবিনয় অনুরোধ করছি। অন্যথায় কয়েক দিনের মধ্যেই পূর্বাঞ্চলে ভারতের সৈন্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে এলে পশ্চিমাঞ্চল বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।
আপনি অনুগ্রহ করে অনুধাবন করতে চেষ্টা করুন যে, অধিকৃত এলাকায় স্থানীয় জনগণ ভারতীয় সৈন্যদের স্বাগত জানিয়েছে এবং তাদের সর্বাধিক সম্ভব সহযোগিতা প্রদান করে চলেছে।
বিদ্রোহীদের অভিযান অব্যাহত থাকার কারণে আমাদের সৈন্যরা নিজেদের প্রত্যাহার করে আক্রমণ চালানোর জন্য পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তানিদের এই পক্ষপাতিত্বের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আত্মত্যাগ অর্থহীন হয়ে পড়ছে। গভর্নর মালেকের বার্তা এখানেই শেষ।
প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এই বার্তা বিশ্লেষণ করলে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, গভর্নর মালেকের পাকিস্তানের প্রতি চূড়ান্ত রাজনৈতিক আনুগত্য থাকার পরও (তা না হলে গভর্নরের পদ গ্রহণ করতেন না) বস্তুনিষ্ঠ এবং হত্যাযজ্ঞ ঠেকানোর মতো একটি বার্তাই তিনি দিয়েছেন। তার বার্তা একই সঙ্গে রণাঙ্গনের চিত্রও তুলে ধরে- পাকিস্তানের পতনের আর দেরি নেই।
একাত্তরের এদিন সকালে হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর ঢাকা থেকে প্রথমবারের মতো জেনারেল নিয়াজী স্বীকার করেন, পরিস্থিতি নিদারুণ সংকটপূর্ণ। আকাশে শত্রুর প্রভুত্বের কারণে পুনর্বিন্যাসকরণ সম্ভব নয় বলে একটি সংকেতবাণীও পাঠানো হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। দ্রুত মুক্ত হতে থাকে একের পর এক জায়গা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সহযোগী যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় পাকিস্তানকে সহযোগিতা করার পদক্ষেপ নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে যে জায়গাগুলো শত্রুমুক্ত হয়, তাদের অন্যতম হলো দাউদকান্দি, গাইবান্ধা, কপিলমুনি, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোনা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা, চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা।
দাউদকান্দি শত্রুমুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এর আগে কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দাউদকান্দির মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাক হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সামনে শুধু ঢাকা দখলের লড়াই। সবদিকে দিয়ে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হলো। বাইরে থেকে হানাদার বাহিনীর প্রবেশ রুদ্ধ হয়ে যায়। মিত্রবাহিনী একে একে আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ দখলে নিয়ে নেয়।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :