ত্রাণের জন্য ছুটছেন বানভাসিরা

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ২২, ২০২২, ১১:১১ এএম
ত্রাণের জন্য ছুটছেন বানভাসিরা

ঢাকা : প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জবাসী। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে সবাই। কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব ততো তীব্র হচ্ছে। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে সামান্য ত্রাণ পাওয়া গেলেও যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছেন তারা পড়েছেন চরম বিপদে। এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তারা। তাই ত্রাণের জন্য দিিবদিক ছুটছেন তারা। সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত বন্যায় ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়।

কয়েকদিন ধরেই সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ করছে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। কিন্তু বন্যায় রাস্তাঘাট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় দুর্গম এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পাঠানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বন্যাসংশ্লিষ্টরা। দুর্গম ওইসব এলাকার মানুষ একদিকে পানি সাথে যুদ্ধ করছেন অন্যদিকে অভুক্ত থেকে অনেকটা মরণাপন্ন অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। পানিবাহিত নানা রোগও ছড়িয়ে পড়ছে মানুষদের মাঝে।

এদিকে, সুনামগঞ্জর তাহিরপুরে ত্রাণ নিতে গিয়ে আহত বিপ্লব মিয়া মারা গেছেন। জানা গেছে, গত সোমবার হেলিকপ্টার থেকে ফেলা ত্রাণ নিতে গিয়ে হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়ে বিপ্লব মিয়া (৫০) আহত হন। ওই ঘটনায় আরো সাতজন আহত হয়েছেন। তাদের তাহিরপুরসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। উপজেলার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে এ ঘটনা ঘটে।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান কবির স্থানীয়দের বরাত দিয়ে বলেছেন, হেলিকপ্টার কিছুটা নিচে নামিয়ে সেখান থেকে ত্রাণসামগ্রী ছুড়ে ফেলা হচ্ছিল। ত্রাণ পেতে বন্যার্তরা ছোটাছুটি হুড়োহুড়ি করতে থাকেন। এ সময় ছয়-সাতজন আহত হন। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা খারাপ বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে দুই জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে পানিতে। সোমবার পর্যন্ত পানিবন্দি ছিলেন অন্তত ৪০ লাখ মানুষ। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিটি করপোরেশনসহ জেলায় ৫৭৭টা আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬ শত ৬২ জন মানুষ রয়েছে। জেলায় সিটি করপোরেশনসহ স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় ২ শত মেডিকেল টিম কাজ করছে।

সিলেট সদর উপজেলার মানসিনগরের রহিমা বেগম বলেন, ২ দিন পূর্বে কোনো ত্রাণ পায়নি। এখানে এখন পর্যন্ত কেউ ত্রাণ নিয়েও আসিনি। তাই খুব কষ্টে আছি। আশপাশের বাসিন্দারা মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে আসেন বলেও জানান শরিফা।

ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা আশরাফ আলী জানালেন, তিনদিনে কোনো সরকারি ত্রাণ পাননি। ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েকজন রান্না করা খাবার দিয়েছেন। রান্না করা খাবার তো রাখা যায় না। একবেলায় খেয়ে ফেলতে হয়। তাই একবেলা খেলে পরের বেলা উপোস থাকতে হচ্ছে।

এদিকে, সিলেট পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, মেঘালয়ের ঢলে সুরমা, ধলাই ও পিয়াইন নদীর পানি বেড়েছে। আসাম থেকে ঢল নামলে কুশিয়ারার পানিও বাড়বে। এখন ঢল নামছে আসাম থেকে। তাই কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে এবং ওই নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

তবে সুরমা নদীর পানি কমলেও আসামে টানা ভারি বৃষ্টির কারণে বেড়ে যাচ্ছে কুশিয়ারার পানি। পানি বেড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে কুশিয়ারা নদীরক্ষা বাঁধের বিভিন্ন জায়গায়। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাঁধ ভেঙে ও উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, ওসমানীনগর ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায়।

পাউবো জানায়, কুশিয়ারা নদীর পানি এতদিন ধীরে বাড়ছিল। গত রোববার থেকে অস্বাভাবিক গতিতে পানি বাড়তে শুরু করে। এতে শুরু হয় বাঁধের ভাঙন। কুশিয়ারা তীরবর্তী উপজেলাগুলোতে লক্ষাধিক মানুষ নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতির সবচেয়ে অবনতি হয়েছে জকিগঞ্জ উপজেলায়।

পাউবো আরো জানায়, গত সোমবার পর্যন্ত জকিগঞ্জ উপজেলায় ৩৯টি বাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে সুলতানপুর ইউনিয়নের ভক্তিপুর, সদর ইউনিয়নের রারাই, বীরশ্রীর সুপ্রাকান্দি, কাজলসারের বড়বন্দ এলাকায়।

পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে আরো ভাঙনের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জে নদী ও নদী তীরবর্তী এলাকা পানিতে একাকার হয়ে গেছে। দুই উপজেলার প্রায় ৬০ শতাংশ প্লাবিত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বালাগঞ্জ-খছরুপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ সড়ক দিয়ে যান চলাচল।

বিয়ানীবাজার উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে উপজেলার চারখাই, আলীনগর, শেওলা, দুবাগ, কুড়ারবাজার ও থানা বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা।

ওসমানীনগর উপজেলাতেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উপজেলার গোয়ালাবাজার, তাজপুর, দয়ামীর, বুরঙ্গা, সাদিপুর, পশ্চিম পৈলনপুর, উসমানপুর ও উমরপুর ইউনিয়নের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গেছে।

তবে সুরমার পাশাপাশি সিলেটের ধলাই, পিয়াইন, সারি ও লোভা নদীর পানি কমছে। এসব নদী তীরবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট ও বিশ্বনাথ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজং বলেন, পানি খুব ধীরগতিতে কমছে। কাল সারা দিনে দুই সেন্টিমিটারও কমেনি। এখনো উপজেলা পরিষদ ভবন পানিতে তলিয়ে আছে।

সিলেট নগরীর উঁচু এলাকা থেকেও পানি নামতে শুরু করেছে। গত সোমবার সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে নেমেছে পানি।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক হিমাংশু লাল রায় জানান, এ পর্যন্ত বন্যায় সিলেট বিভাগে ২০ জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছি। এর মধ্যে সিলেটে ১২ জন, মৌলভীবাজারে তিনজন ও সুনামগঞ্জে পাঁচজন।

গতকাল সকালে সিলেটের জৈন্তাপুরে মা-ছেলের মরদেহ ভেসে উঠেছে। তাৎক্ষণিক এ দুই মরদেহের তথ্য তার কাছে নেই। তবে এ তথ্য যোগ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী, বন্যায় সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।

এর আগে সোমবার পর্যন্ত সিলেটের জেলা প্রশাসক একজনের, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তিনজনের ও ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একজনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে স্থানীয় সূত্রে আরো কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সত্যতা নিশ্চিত করেনি প্রশাসন।

বিদ্যুৎ, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট না থাকার কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর তথ্য জানা যাচ্ছে। গতকাল সকালে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত এলাকায় পানিতে ভেসে আসে নাজমুন্নেসা ও তার ছেলে আব্দুর রহমানের মরদেহ। তারা দরবস্ত ইউনিয়নের কলাগ্রামের বাসিন্দা।

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যাকবলিতদের উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আমরা কানাইঘাট থেকে অসুস্থ অবস্থায় সাতজনকে উদ্ধার করেছি। তার মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে মৃত্যুর কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!