ঢাকা : পরিচয়হীন রাস্তায় পড়ে থাকা অনাথ অবুঝ শিশুরা যার মাতৃস্নেহে ফিরে পায় শান্তির নীড়। যে শিশুরা জানে না তাদের বাবা-মা কে বা কোথায়। সেই মাতৃহারা শিশুরা যাকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। যার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, সবকিছু যাকে ঘিরে। যিনিই ওদের মা। মায়ের ভালোবাসা দিয়ে সবটুকু উজাড় করে নিজের সন্তানের মত লালন পালন করেন তিনি হলেন রাজধানীর আজিমপুর ছোটমণি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক জুবলি বেগম রানু। ২০১৬ সাল থেকে ছোটমণি নিবাসে মা-বাবা হারা এতিম এই শিশুদের মাতৃস্বেহে লালন পালন করছেন তিনি।
ছোটমণি নিবাসে গিয়ে দেখা যায়, জুবলি বেগম রানুর তত্ত্বাবধানে অভিভাবকহীন শিশুরা এতোটাই আস্থা ফিরে পেয়েছেন যে সবাই সবসময় পুরো ঘরটিকে মাতিয়ে রাখছে। সবাই একসঙ্গে খেলাধুলা করে, কেউ কেউ পড়াশোনা করছে, বাইরে থেকে কেউ আসলে দেখা যায় তাদের জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিৎকার করছে। পিছে পিছে ঘুরছে, লাফালাফি করছে। কোলে ওঠছে। ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হচ্ছে। খাবার সময় হলে একসঙ্গে খাবার খেতে দৌড়ে যাচ্ছে। নতুন শিশু আসলে তাকে দেখে তারা আনন্দে আত্মহারা।
জানা গেছে, ছোটমণি নিবাসে একটা শিশু শূণ্য থেকে ৭ বছর বয়স পর্যন্ত অবস্থান করে। যাদের বেশির ভাগ পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন, পরিত্যক্ত, পাচার হতে উদ্ধার, হাসপাতালে ফেলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া শিশু, যাদের দাবিদার কেউ নেই। সমাজসেবা অধিদফতর ৬ বিভাগে অবস্থিত ৬টি ছোটমণি নিবাসে এই সকল শিশুদের মাতৃস্নেহে প্রতিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ, খেলাধুলা ও সাধারণ শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা, ও বিনোদনের ব্যবস্থা করে। সাত বছর বয়সের পর এদের সরকারি শিশু পরিবারে স্থানান্তর করে। এখানে ২৮-৩০ জনই অবস্থান করে।
বিষয়টি নিয়ে জানাতে চাইলে রাজধানীর আজিমপুর ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলি বেগম রানু সোনালীনিউজকে বলেন, ছোটমণি নিবাস ওই সকল শিশুরা আসে, যে শিশুর ১দিন বয়স থেকে ৬ বছর পর্যন্ত যার কোন দাবিদার কেউ নাই। অভিভাবক নাই। পরিবার নাই। সেই শিশু যাকে রাস্তা থেকে তোলা হয়। এরপর জিডি হয়। জিডির পর আইনের মাধ্যমে হউক। বা হাসপাতালে কেউ ফেলে গেলে। হাসপাতালের মাধ্যমে এই শিশুরা এখানে আসে। বর্তমানে এখানে ২৮ শিশু আছে।
‘এখানে বাচ্চার বেশ হাসি খুশিতে মেতে থাকে। ওদের খাওয়া-দাওয়া। টেককেয়ার করা। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি ওদেরকে কিভাবে ভালো রাখা যায়। যেকারণে ওরা সবসময় খুব উৎফুল্ল থাকে। অনেকে মানে করে এটা একটা এতিম খানা। কেউ বাচ্চা পালতে পারছে না। পালার সক্ষমতা নাই। যাই এতিম খানায় দিয়ে আসি। এই ভাবনা নিয়ে অনেকে আসে। কিন্তু এটা এতিম খানা না। এটা ছোটমণি নিবাস।’
এছাড়াও ব্যতিক্রম কিছু শিশু আসে জানিয়ে তিনি বলেন, কোন শিশুকে নিয়ে মা-বাবা আদালতে মামলা করলে তার মিমাংসা না হওয়া পর্যন্ত শিশু কল্যাণ বোর্ডের অধিনে ছোটমণি নিবাসে থাকে। এখানে সব রকমের সুরক্ষা পায়।
জুবলি বেগম রানু বলেন, ছোটমণি নিবাস থেকে ক্যারিয়ারটা শুরু হয় অনাথ শিশুদের। যদিও যারা এখানে আসে তারা অনেক ছোট। তারাতো ক্যারিয়ার শব্দটার সাথে পরিচিত না। আমরা যারা ওদের লালন-পালন করি আমাদেরও ক্যারিয়ার শব্দটা মাথায় থাকে না। ক্যারিয়ার শুরু করার বয়স এ সময় হয় না। তবে হ্যাঁ। একটা সুস্থ্য স্বাভাবিক শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে তার যা যা প্রয়োজন আমরা সেটাকে মাথায় রাখি। এখানে প্রি-প্রায়মারি স্কুলের সুযোগ আছে। সেই হিসেবে একজন হুজুর আছেন। যিনি এ ঘণ্টা শিশুদের সাথে থাকেন। তিনি শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেন। যাতে ছোট থেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। নম্রতা, ভদ্রতা শিখবে। কেননা ছোট বেলায় যা শিখে বড় সেভাবে চলে। আর এই ক্যারিয়ারটা এখান থেকে শুরু হয়। সন্ধ্যার পর বাংলা শিক্ষক আসেন যিনি ছড়া কবিতা, অক্ষর জ্ঞানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
এছাড়া আমাদের নিজস্ব শিক্ষকও রয়েছে যারা খেলাধুলাসহ অন্যান্য বিষয় গুলো শিক্ষা দেন। আর এভাবে এই শিশুরা তাদের জীবনের প্রথম ধাপটা শুরু করে। ফলে আমাদের বাচ্চার যথেষ্ট ভদ্র, অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আচার ব্যবহার, সহনশীলতা, শেয়ারিং, তারা ছোট হলেও যেকোন বিষয় একে অন্যের সাথে শেয়ার করে। যেমন : কাউকে একটা চকলেট দিলাম, সে কিছুক্ষণ বসে থাকবে। এরপর এক মিনিটের মধ্যে গিয়ে সবাই বলেদিবে যে তাকে চকলেট দেওয়া হয়েছে। তখন সবাই চলে আসবে বলবে যে তাদেরকেও চকলেট দিতে হবে। আর ওরা জানে কেউ চুরি করে ক্ষেতে হবে না। সবাইকে দিয়ে ক্ষেতে হবে। সবাই পাবে।
তিনি আরও বলেন, এখানে ১ দিন থেকে ৬ বছর পর্যন্ত থাকে। এরপর শিশু পরিবারে ভর্তি হয়। ওখানে ভর্তির বয়স ৬-৯। ওখানে তারা স্কুলে যায় লেখা পড়া শিখ। খেলাধুলাসহ সব কিছুর সুযোগ পায়। এরপর বাহিরের স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে।
আমাদের এখান থেকে যত বাচ্চায় বিভিন্ন পরিবারে গিয়েছে সবার সাথে যোগাযোগ থাকে। ওই পরিবারও অনেক হ্যাপি। বাচ্চাদের নিয়ে কোন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি জানিয়ে আজিমপুর ছোটমণি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক সোনালীনিউজকে বলেন, আমরা ওইসব পরিবারে বাচ্চাদের দিয়ে থাকি যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। ফলে এখানকার বাচ্চারা অনেক ইংলিশ মিডিয়ামেসহ ভালো ভালো স্কুলে পড়তেছে। তারা ভালো করতেছে এবং তারা প্রথম-দ্বিতীয় হচ্ছে। মা-বাবার খুব খুশি হয়ে কল দেয়।
‘বাংলাদেশে দত্তক আইন নাই। আমরা পারিবারিক আদালতে মাধ্যমেই দেই। লিগ্যাল গার্ডিয়ান হিসেবে আইনগত অভিভাবক্ত। আমরা প্রতিনিয়ত খবর রাখি। কারণ এখনতো মিডিয়ার যুগ। খবর নেওয়াটা খুব একটা কঠিন না। অভিভাবকরাও যোগাযোগ রাখে। তবে যারা একেবারে ছোট বাচ্চা নিয়ে গিয়েছেন তারা একটু যোগাযোগ কম রাখে। এর কারণও আছে। আমাদের সাথে দেখা হলে বাচ্চারা আমাদের কাছে চলে আসতে চায়। আমাকে চিনে ফেলবে। অনেক অভিভাবকেই চায় ওরা এখানকার স্মৃতিটা ভুলে যাক।’
জুবলি বেগম রানু সোনালীনিউজকে আরও বলেন, আমরা ছোট থেকে বাচ্চাদের যেভাবে গড়তেছি। বেশ ভালো। তবে কিছু আসে একটু বড়। ৩-৫ বছরের। যারা বস্তি থেকে আসে। প্রথম দিন থেকে তাদেরকে দেখে আমরাও ভয় পাই। তাদের কথা বার্তা। আচার-আচরন। কিন্তু আল্লাহ অশেষ রহমত কিছু দিন থাকলেই ওদের সব পরিবর্তন হয়ে যায়। ওই রকম নতুন একটা বাচ্চা আসলেও আমরা সবাই ওর দিকে মনোযোগ দেই। কতক্ষণে তাকে মূল স্রোতে নিয়ে আসতে পারি। মাঝে মাঝে দুই একটা খারাপ কথা বলে। তবে অন্যরা আবার বলে খানামনিকে বলে দিব। ওরা আমাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি আবার ভয়ও পায়।
নিজের হাতে লালন পালন করা এই সোনামণিরা যখন অন্যত্র চলে যায় তখন বুকের মধ্যে ‘দুমড়ে মুচড়ে’ যায় জুবলি বেগম রানুর। তাদের স্মৃতির কথাগুলো বলতে গিয়ে নিজে আর ধরে রাখতে পারেননি। নিজের অজান্তেই চোখে বেয়ে বেড়িয়ে আসে অশ্রু। অশ্রুভেজা নয়নে তিনি বলেন, একটা পশু-পাখি পাললেও মানুষের মায়া হয়। আর ওদেরকেতো আমরা একদম নিজের মত করে লালন-পালন করি। নিজের সবটুকু দিয়েই লালন-পালন করি। ওদের সাথেইতো আমরা দিনের অধিকাংশ সময় থাকি। যেকারণে ওদের প্রতি আমাদের সব রকম কেয়ারিং থাকে। ওদেরও আমাদের প্রতি আস্থা। আপনি নিয়ে যেতে চাইলেও পারবেন না। কেউ কিন্তু আপনার সাথে যাবেন। যদি আমি বলি চল দিধাহীন ভাবে চলে যাবে। তার মানে ওর বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা সবকিছু কিন্তু আমাকে ঘিরে। আমিই ওদের মা। যেমন একটা মাকে ঘিরে থাকে। আমাকে ঘিরে আমাদেরকে ঘিরে। আর সেই বাচ্চাকে যখন কারও কাছে তুলে দেই বা চলে যায়। তখন খারাপ তো লাগেই। তবে আমরা মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তত করিছি যে আমরা ওদের ভালো চাই। ভবিষ্যৎ চাই।
‘আমাদের কাছেতো ওদের কোন ভবিষ্যৎ নাই। প্রতিষ্ঠানতো প্রতিষ্ঠানই। প্রতিষ্ঠানতো আর পরিবারের বিকল্প হতে পারে না। তারপর ওদেখা যায় যে সব বাচ্চাও একরকম না। আবার কারও কারও জন্য হয়তো কখনও কখনও নিজের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। কখনও কখনও হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে বুকে মধ্যে দুমড়ে মুছড়ে যায়। কষ্ট হয়। নিজেকে বোঝায় যে এটা চাই যে ওরা ভালো থাক। কান্না...। আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক। ওইযে মানের কাছে এক যাগায় বুঝ দেওয়া ওরা ভালো থাক, ভালো আছে। যখন দেখি আমাদের মনে মত হচ্ছে না। তখন একটু কষ্টই লাগে। সব সময় সবটাই যে শতভাগ হবে এমনটাও না। কিছু দিন আগে একটা বাচ্চার মা মারা গেল। ওর বাবাটা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। ওর খোজ খবর নিয়েছি। ওকে একটা হোস্টেলে দেওয়া হয়েছে। সেই মা হারা বাচ্চা আমাদের কাছে আসলো। এখন মা হারাই হয়ে গেল। প্রকৃতির কিছু নিয়মতো আমি আপনি চাইলেও খন্ডাতে পারবো না। তাদেরকে বার বার অনুরোধ করেছি মা নাই তাই বাচ্চাটার যেন কোন অবহেলা না হয়। মাও মরার আগে বলে গেছে ওকে তোমার অবেহেলা করো না।’
সহকারি সেবিকা লাভলী পারভিন সোনালীনিউজকে বলেন, আমার এখানে ২৮ জন বাচ্চা আছে। এরা ৭টা মধ্যে ঘুম থেকে ওঠে। ওদেরকে ছাদে ঘুরাতে নিয়ে যাই। ৯টার মধ্যে ওদের গোসল কারাই। এখানে সরকারি-বেসরকারি নিয়ে মোট ৮ জন আয়া আছে। চারটা শিফটে আমরা কাজ করি। ওরা যেহেতু ছোট তাই অনেক দুষ্টামি করে। বাচ্চাদের পালার ক্ষেত্রে তখন আমরাতো একটু ধৈর্য্য হারাতেই হয়। যদি বলি ধৈর্য্য হারাই না তাহলে মিথ্যা হবে। তারপরও কিছু করার নাই। এখন জবের জন্য হউক। আবার এতিম বাচ্চা। এদের যদি আমরা না দেখি তাহলে কে দেখবে। ধৈর্য্য হারা হলেও আমরা ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করি না। আমরা আমাদের আবেগ থেকে ভালোবাসা থেকে ওদের লালন পালন করি। কারণ এতো ছোট একটা বাচ্চা যে দেখবে সেইতো মায়া করবে। জিরো থেকে একটা বাচ্চাকে আমরা মায়ের মত করে কোলে পিঠে করে মানুষ করতেছি তখন ওদের প্রতি একটা মায়া এমনিতেই কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, কেউ যখন চলে যায় তখন আমাদের খুবই কষ্ট লাগে। কিছুদিন আগে একটা বাচ্চা গেছে ওর বয়স ১ বছর ৩মাস। ইদের পর প্রথম অফিস ডে গেছে। ওর কথা আমরা এখনও ভুলতে পারিনা। ওকে আমরা একদম পরিবারে মতো করে বড় করেছি। সবাই ওকে এতো ভালো বাসছে। মনে হলে সবাই কান্না করে। দুই তিন মাসে বাচ্চাদের জন্য অতো খারাপ লাগে না। কিন্তু ১ দেড় বছর পরে লালন পালন করা পরে যায় তাদের জন্য বেশি খারাপ লাগে। তারপরও কিছু করার নাই। ওরা একটা পরিবার পাচ্ছে এটাই আমাদের জন্য শান্ত না। এটাই ভালো লাগা। এখানেতো এদের কোন ভবিষ্যৎ নাই। কিন্তু যখন পরিবারে যাবে তখনতো একটা ভবিষ্যৎ গড়ে গেল। তখন আমাদের অনেক ভালো লাগে যে আমাদের বাচ্চারা একটা পরিবার পেল। আর যে বাচ্চার এডাপশনে যায় না যখন আমাদের শিশু পরিবারে ওদের লালন পালন করা হয়। যদিও এটা খুব কম।
আরেক সেবিকা তানিয়া সুলতানা ২০১৯ সাল থেকে কাজ করেন ছোটমণি নিবাসে। সোনালীনিউজকে তিনি বলেন, সার্বক্ষণিক বাচ্চাদের সাথে থাকা হয়। এদের সাথে কাজ করতে করতে একটা ভালো লাগা কাজ করে। এরা এতিম বাচ্চা, এদের কেউ নাই। ‘বাচ্চারা হল ফুলের মত পবিত্র’। এদের সাথে সারাদিন সময় কাটানো, খেলাধুলা, খাইয়ে দেওয়া, গোসল করানো, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। এগুলো সব নিজের হাতে করি। একেবারে নিজের বাচ্চার মত মনে করে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :