ঢাকা : বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণায় আওয়ামী লীগ সরকার গুরুত্ব দিয়েছে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫-এর পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় পালাক্রমে বসে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এবং স্বৈরাচারী সামরিক শাসকেরা। শিক্ষাঙ্গনে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সামরিক শাসক জিয়া ছাত্রদের হাতে তুলে দেয় অবৈধ অস্ত্র ও কালো টাকা। তাদের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। গবেষণা তো দূরের কথা, শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়।
রোববার (৯ জুলাই) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ ২০২৩-২৪ এর নির্বাচিত ফেলোদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রথমবারের মতো এ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও ফেলোশিপপ্রাপ্তদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাজেটে জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিন্যাসের পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ওই অর্থবছরে শিক্ষাখাতে এদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২১.১৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তিনি সব স্কুল-কলেজ পুনর্গঠন করেন এবং নতুন বিদ্যালয়-কলেজ ভবন নির্মাণ করেন। তিনি ১ লাখ ৬৫ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি এবং ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন।
জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কিন্তু, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর ড. কুদরাত-ই-খুদা কমিশনের সেই রিপোর্ট আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
১৯৭৩ সালে তিনি মহান জাতীয় সংসদে বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন। একই বছরে তিনি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৪ সালে জাতির পিতা ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা এবং আণবিক শক্তি বিভাগ’ নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ সৃষ্টি করেন। আণবিক কমিশন গঠন করেন। ১৯৭৪ সালেই তিনি ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়’ গঠন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫-এর পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় পালাক্রমে বসে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এবং স্বৈরাচারী সামরিক শাসকেরা। শিক্ষাঙ্গনে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সামরিক শাসক জিয়া ছাত্রদের হাতে তুলে দেয় অবৈধ অস্ত্র ও কালো টাকা। তাদের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। লাশের পর লাশ পড়তে থাকে ক্যাম্পাসগুলোতে। গবেষণা তো দূরের কথা, শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। সেশনজট অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। জাতির পিতা হাজিদের জন্য হিজবুল বাহার নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেছিলেন। দুঃখের বিষয় জিয়াউর রহমান এ হিজবুল বাহার জাহাজকে প্রমোদ তরী বানিয়েছিলেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের নিয়ে যাওয়া হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে তখনই জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষাসহ প্রতিটি সেক্টরের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরা ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে শিক্ষা এবং গবেষণায় গুরুত্ব দেই। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে প্রথম ১২ কোটি টাকা গবেষণা অনুদান প্রদান করি। পরবর্তীকালে গবেষণা ও প্রযুক্তির জন্য এ অনুদান ১০০ কোটিতে উন্নীত করি। আমরা ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বায়োটেকনোলজি ইনস্টিটিউট, নভো থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করি।
বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু বৃত্তি চালুর বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের আওতায় ৯৮৬ জন শিক্ষার্থী/গবেষককে ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বৃত্তি/অনুদান প্রদান করি। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০’ প্রণয়ন করি, যা বিএনপি/জামায়াত জোট সরকার বাতিল করে দেয়। আমরা ২০০৯ সাল থেকে শিক্ষা-গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করছি। ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হচ্ছে। ২০১০ সালে একটি সমন্বিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছি। আমরা ব্যান্সডক আইন-২০১০, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন ট্রাস্ট আইন-২০১১, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট আইন-২০১৫, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ আইন (সংশোধিত)-২০১৮, ‘বাংলাদেশে উচ্চ-শিক্ষার কৌশলী পরিকল্পনা: ২০১৮-২০৩০’ সহ প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছি।
২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তথ্য জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, এর মধ্যে রয়েছে কৃষি, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সাইন্সেস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ডিজিটাল, ইসলামি-আরবি, টেক্সটাইল, মেরিটাইম, এভিয়েশন ও এরোস্পেস, বেসরকারি ফ্যাশন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করছি।
বর্তমান সরকার শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থ-বছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা আহরণে সক্ষম প্রজন্ম গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন করেছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-২০৩০ বাস্তবায়নে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আমরা রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও সক্ষম জনবল। এ লক্ষ্যে আমরা উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের নীতিমালা ও সুযোগ সুবিধা যুগোপযোগী করে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেইনিং পলিসি-২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে।
আর এ বাস্তবতা থেকেই দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানব সম্পদ গড়ার লক্ষ্যে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ প্রবর্তন করা হয়। এর আওতায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্থাৎ মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ফেলোশিপের অধীনে সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অন্যান্য বেসরকারি ব্যক্তিবর্গ বিদেশের ওয়ার্ল্ড ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছেন।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের আওতায় ৯৮ জনকে পিএইচডি এবং ২৩৯ জনকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের জন্য ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এর মধ্যেও আমরা এ ফেলোশিপ প্রদান অব্যাহত রেখেছি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের আওতায় ২৬৬ কোটি টাকা ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে।
ফেলোশিপপ্রাপ্তদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জনগণের করের টাকায় আমরা গবেষণা অনুদান ও ফেলোশিপ দিয়ে যাচ্ছি। নির্বাচিত ফেলোদের প্রতি আমার অনুরোধ, জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় আপনারা যে জ্ঞানার্জন করবেন তা যেন জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো হয়। আগে মেধাবীদের দেশে ধরে রাখার কোন উদ্যোগ ছিল না। তেমন কোনো প্রতিষ্ঠানও ছিল না। আমরা কিন্তু এখন অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে দিয়েছি। শুধু মৌলিক গবেষণা নয়, প্রায়োগিক গবেষণার ওপর আমরা জোর দিয়েছি। কৃষি, শিল্প স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে গবেষকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের গবেষণায় আরও বেশি এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, যাতে করে দেশীয় উদ্ভাবিত প্রযুক্তির বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সব প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রচলিত প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে দক্ষ জনশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অধ্যয়ন ও গবেষণা হতে হবে দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার আলোকে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২০১২ সালে আমি গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ) প্রতিষ্ঠা করি। “সবার আগে নাগরিক” এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে নাগরিক সেবার মান উন্নয়নে নতুন নতুন উদ্ভাবনের দায়িত্ব দেওয়া হয় জিআইইউকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই ইউনিটটি সেবা সহজিকরণ ও গবেষণামূলক কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি ২০১৮-১৯ অর্থবছর হতে পরিচালনা করে আসছে প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপ কার্যক্রম। আমি জিআইইউ টিমকে ধন্যবাদ জানাই।
আমাদের সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে বিগত সাড়ে ১৪ বছরে বাংলাদেশ বদলে গেছে। এ সময়ে মাথাপিছু আয় প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জিডিপি ৭.৭৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মানুষের গড় আয়ু ৫৫ বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৩ বছর। নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ইত্যাদি নানা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে অবস্থান করছে। এসব সম্ভব হয়েছে অব্যাহত গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং স্থিতিশীলতা বজায় থাকার কারণে। এ সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :