দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

জঙ্গি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সামলাতে কতটা প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

  • লাইজুল ইসলাম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৩, ০৯:১৯ পিএম
জঙ্গি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সামলাতে কতটা প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

ফাইল ছবি

ঢাকা: চলতি বছর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পরিবর্তন আনা হয়েছে বছর জুড়েই। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও সেনা বাহিনীর সদস্যরা সাধারণত নির্বাচন কালীন নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকেন। পুলিশ-র‌্যাব-আনসার সদস্যরা বেশির ভাগ সময় দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ প্রয়োজনে মাঠে নামানো হয় বিজিবি ও সেনাবাহিনীকে। তবে কারা দায়িত্ব পালন করবে সেই হিসেব-নিকেশ পুরোটাই নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর। তারা নির্বাচনে কিভাবে কি করতে চায় সেই অনুযায়ী কাজ করেন আইন-শৃঙ্খলায় দায়িত্বে থাকা বাহিনীগুলো।

নির্বাচনের কিছুদিন আগে কমিশনের অধীনে থাকে এ বাহিনী। কিন্তু তার আগের সময়টাতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন তারা নিজের মতো করে পুলিশ বাহিনীকে সাজান। সেই কার্যক্রম চলে পুরো বছর জুড়ে। বাংলাদেশে পুলিশের মেট্রোপলিটন, জেলা, রেঞ্জগুলোতে ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। আরো কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানা গেছে।    

এদিকে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই বৈরিতা বাড়ছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে। দু’দলের সম্পর্কে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসেনি। এখনো এক টেবিলে বসতে পারেনি। আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ কাউকে কোনো ভাবেই ছাড় দিতে রাজি নয়। বিএনপি বলছে তত্বাবধায়ক সরকারের অধিনেই নির্বাচন হতে হবে। আর আওয়ামী লীগ বলছ সংবিধানে তত্বাবধায়ক বলতে কিছু নেই। তাই নির্বাচিত সরকারের অধিনেই সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। 

দিন যত যাচ্ছে, ততই রাজনীতির মাঠে মুখোমুখি হচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। ইদানীং একের পর এক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে বিএনপি। আওয়ামী লীগও মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলটির শীর্ষনেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, কর্মসূচির নামে বিএনপি নাশকতা করলে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সঙ্গত কারণে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের এই বৈরিতা কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী? 

পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি খালেদা জিয়ার মুক্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও হয়রানি বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে সরকারবিরোধী একের পর এক কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। ফলে বিএনপিকে কোন কৌশলে মোকাবিলা করবে সেটি নিয়ে ভাবছে পুলিশ। তাদেরকে নির্বাচনে আনতে চায় সরকার। তাই সব কর্মসূচি পালনে পুলিশ সহযোগীতা করছে। তবে বিএনপি কর্মসূচি পালনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলনের নামে বিএনপি নাশকতা করলে কঠোরতার মাত্রা বাড়াবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনিক সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবে সরকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে পুলিশের পাশাপাশি প্রশাসনের অন্যান্য বাহিনীও মাঠে থাকবে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সব কিছুই করবে সরকার। ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকও করেছেন। 

বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে আসছেন। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার পর তারা আরও তৎপর হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন এবং তফসিল ঘোষণার পরপরই তারা পুরোদমে মাঠে নামবেন এমন ঘোষণাও দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তাদের যে কোনো আন্দোলন মোকাবিলায় আওয়ামী লীগও একাধিক কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। এই দুই দলের হুমকি ও বৈরাতর কারণে যাতে দেশে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আইন-শৃঙ্খল বাহিনীর সদস্যরা। 

জানা গেছে, ইতোমধ্যে দুই দলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের চলাচলের ওপর কঠোর নজরদারি রাখছে গোয়েন্দারা। বিশেষ করে বিএনপির নেতাদের দিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। এতে রাজধানী ও রাজধানীর আশপাশের এলাকার বেশ কিছু নেতা রয়েছেন। বিভাগীয় শহরের ও জেলা শহরের নেতারাও রয়েছেন এই তালিকায়। তাদের পরিবারের সদস্যদের গতিবিধিও ট্র্যাক করা হচ্ছে। যাতে কোনো ভাবেই কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। 

ক্ষমতায় থাকা দলেরও বেশ কিছু নেতা আছেন এই নজরদারির মধ্যে। এই নেতারা বিভিন্ন সময় দলের ভেতরে থেকে সংঘর্ষ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। অনেকে সংঘর্ষ ঘটানোর সঙ্গে জড়িতও আছে এমন কিছু তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে। নির্বাচনের আগে কারা দলের জন্য ক্ষতিকর তাও জানতে চায় বর্তমান সরকার। তাই তাদের ওপর নজরদারি চলছে। যারা বিগত সময়গুলোতে দলের শৃঙ্খলা ভেঙেছে তাদের ওপরও নজরদারি চলছে। তাই সব মিলিয়ে দুই দলের বেশ কিছু নেতাই রয়েছেন নজরদারিতে। 

নির্বাচনের আগে পুলিশ ও র‌্যাব সন্ত্রাসী বিরোধী অভিযান পরিচালনা করবে বলে জানা গেছে। এই সন্ত্রাসীরা কোন দলের তা দেখা হবে না। দেখা হবে কে সরকারের জন্য হুমকি। যে বা যারা সরকারের ও নির্বাচনী সময়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সংঘর্ষ এড়াতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। 

সূত্র বলছে, নির্বাচনের আগে সোস্যাল মিডিয়ায় সর্বোচ্চ নজরদারি চলবে। এজন্য ফেইসবুকের সঙ্গে প্রশাসনিক আলোচনা চলছে। তাদের মাধ্যমে নির্বাচন কেন্দ্রীক যে কোনো ধরনের অপপ্রচার ঠেকাতে চায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেরও নজরদারি চালাতে চায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা আনা হয়েছে বাহিনীগুলোতে। 

এদিকে, হঠাৎ করে গত কয়েক মাস ধরে দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড়ে ও সমতলে জঙ্গিদের কার্যক্রম একই সঙ্গে চলছে। যদিও এখনো জঙ্গিরা কোনো হামলা কোথাও চালাতে পারেনি। তার আগেই অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছে। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া নিয়ে চিন্তা ছড়িয়ে পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে। তারা পাহাড়ে শুরু করে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকবল সংগ্রহ করে তারা। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বাড়ি ছাড়া করা হয় বহু যুবককে।

সংগঠনটি বান্দরবানের গহীন জঙ্গলে সন্ত্রাসী সংগঠন কুকী চিনের সঙ্গে কোলাবরেশন করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকে। এই সময় পাহাড়ে অভিযান শুরু করে র‌্যাব পুলিশ ও সেনাবাহিনী। এতে বেশ কয়েকজন কুকি চিন নেতা গ্রেপ্তার হয়। জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরাও গ্রেপ্তার হয়। এছাড়া বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্য র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই সংগঠনের আমীরকেও গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এমন পরিস্থিতিতে তাদের হামলা করার এই মুহূর্তে কোনো সাংগঠনিক শক্তি নেই বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এদিকে মৌলভিবাজারেও নতুন আরেক জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। তাদের প্রায় ৩০ জনের ওপরে সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

তবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নির্বাচনের এই বছরে রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে তারা নিজেদেরকে আবার উজ্জীবিত ও সুসংগঠিত করে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা তাদের। তবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আর জঙ্গি হামলা করা সম্ভব নয় বলে দাবি করেছেন পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা। 

সোনালীনিউজ/এলআই/আইএ

Link copied!